বঙ্গমাতার হাতের মুড়ি গুর খেয়ে শামীম ওসমান সকালে নাস্তা করতেন।
সাহাদাৎ হোসেন শাহীন, জেলা প্রতিনিধি-(নারায়ণগঞ্জ)
বঙ্গমাতার হাতের মুড়ি গুর খেয়ে শামীম ওসমান সকালে নাস্তা করতেন।
শনিবার ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনে যার অসামান্য অবদান, যার সহযোগিতায় ‘শেখ মুজিব’ হয়ে উঠেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
সেই বঙ্গমাতাকে নিয়ে নিজের এক স্মৃতিচারণ আর অনুভূতি দৈনিক যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমান।
শামীম ওসমান বলেন, ঘটনাটি ১৯৭৪ সালের। একদিন রাতে আমাদের বাসার ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। আমি ধরে সালাম দিলাম। অপর প্রান্ত থেকে বেশ দরাজ কণ্ঠে বললেন, ‘কে রে?’ আমি বললাম, শামীম। আবার উত্তর দিয়ে বললেন, ‘তোর বাবারে দে’। তখন আমি কথা শুনে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম।
বাবাকে (স্বাধীনতার পদক প্রাপ্ত একেএম সামসুজ্জোহা) বললাম, কে যেন ফোন করে বলছে, ‘তোর বাবাকে দে’। আমার আব্বা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বঙ্গবন্ধু। এটা শুনে আমার শরীরে মনে হল বিদ্যুৎ চমকে গেল, যে আমি জাতির পিতার সঙ্গে কথা বলছি।
‘পরে আমার বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন বঙ্গবন্ধু। পরে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ওই সময়ের মিশরের প্রেসিডেন্ট আসবেন।’
শামীম ওসমান বলেন, আমি ফোনটা বাবাকে দিলাম, তিনি কথা বললেন। কথার বিষয়বস্তু হচ্ছে- মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশে আসবেন। মাছ লাগবে, পাঠানোর ব্যবস্থা করো। বাবা বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি।
চান্দু সরকার নামে একজন ছিলেন, চান্দু কাকা। আমার বাবা তাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু ফোন করেছিলেন, তার মাছ লাগবে। কাকা বললেন, কোনো চিন্তা কইরেন না। সকাল বেলা মাছ পাঠাচ্ছি। চারারগোপে তখন মাছ উঠতো। আমার বাবা আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তুমি যাবা মাছ নিয়ে?
আমি বললাম, হ্যাঁ। আমার তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে একটি জিনিস আমি পেতে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমি একা মাছ নিয়ে যাবো, সেটা শুনে তো সারা রাত আর ঘুমাতে পারি নাই।
‘ভোর ৪টার দিকে সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে আমি আর গাড়িচালক আজগর ভাই দুজন গেলাম ধানমণ্ডিতে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দেখলাম মাত্র দুজন প্রহরী। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিল রাষ্ট্রপতির বাসায় যাবো অনেক গার্ড থাকবে, বিশাল ঘর থাকবে। আমাদের গাড়ি চালক আজগর ভাইয়ের গলার কণ্ঠস্বর ছিল অনেক ভারি। তিনি বাড়ির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে গেট খুলতে বললে পুলিশ খুলতে রাজি হচ্ছিল না।’
‘আজগর ভাই তখন বলেন, আমারে চিনো না, গেট খুল’। পুলিশ তখন জানায়, আপনাদের চিনে কাজ নাই সাহেব এখনও ঘুমে, পিএস আসে নাই। আমাদের কথা শুনে দেখলাম ভবনের তৃতীয় তলায় বঙ্গবন্ধু সাদা চেকের একটি লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে হাতে পাইপ।
তৃতীয় তলা থেকে তিনি বললেন, কে রে। তখন আজগর ভাই বললো, আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছি। বঙ্গবন্ধু বললেন কে আজগররে। উত্তরে আজগর বললো, হু আপনি কী অহন আর আমাদের চিনবেন। এখন তো আপনি রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে বললেন আসছিস, দাঁড়া আমি নামতেছি। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে এলেন।’
নিচে এসে আমাকে বললেন, কিরে, লেখাপড়া ঠিক মতো করিস তো। আমি উত্তর দিলাম, জী করি। বঙ্গবন্ধু বললেন, যা তোর চাচি রান্নাঘরে আছে মাছটি নিয়ে যা। তখন আমার এত রাগ উঠলো। আর মাছটির ওজন ছিল আমার চেয়েও বেশি। পরে পুলিশের সহায়তায় মাছ নিয়ে গেলাম রান্নাঘরে। আমি হলাম মালিক, আমাকে বলে মাছ নিয়ে যেতে আর ড্রাইভার আজগর ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বঙ্গবন্ধু তার রুমে নিয়ে গেলেন।
পরে আমি বঙ্গবন্ধুর কথায় মাছ নিয়ে গেলাম রান্নাঘরে। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখি বঙ্গমাতা রান্নাঘরে রান্না করছে। আমার মাছ নিয়ে তিনি নিজেই কাটতে শুরু করলেন। আমি আরও অবাক হলাম।
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী নিজে রান্না করছে। আমাকে বসতে দিলেন একটি পিড়িতে। আমি তখন বাধ্য হয়েই সেখানে বসলাম। পরে আমাকে নাস্তা হিসেবে খেতে দিল মুড়ি ও খেজুরের গুড়। এটা দেখে আমার কান্না হওয়ার মতো উপক্রম হলো।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সেগুলো খেলাম। তখন আমার কাছে আমার মায়ের খোঁজ খবর নিলেন। কারণ তিনি ও বঙ্গবন্ধু আমার মাকে ভালবাসতেন। যাওয়ার সময়ে আমাকে বঙ্গমাতা বললেন, ঠিক মতো লেখাপড়া করিস। আমি চিন্তা করছিলাম বাড়িতে গিয়ে আব্বাকে বলবো আমাকে আর কখনও এ বাড়িতে পাঠাবেন না।
আমরা বের হওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন ঠিকমত পড়ালেখা করিস কিন্তু। ওই সময়েও আজগর ভাইয়ের কাঁধে বঙ্গবন্ধুর হাত ছিল। পরে গাড়িতে ওঠার পর আজগর চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম নাস্তা করেছেন কী দিয়ে, বললো পাউরুটি দিয়ে।
বললাম, আপনাকে এত বঙ্গবন্ধু ভালোবাসেন কেন। জানালেন, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকার কয়েকটি স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। তখন সঙ্গে ছিলেন আজগর। ’৬৬ এর পর ’৭৪ সালে প্রথম আজগর ভাইকে দেখেই চিনে ফেললেন। এটাই আসলে বঙ্গবন্ধু। তিনি কী জিনিস সেটা এখন বুঝেছি।