রাজনীতি

পুরো সুস্থ না হয়েও কেন বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া ?

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৫৪ দিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়ার পর শনিবার রাতে বাসায় ফিরেছেন।খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসক টিমের প্রধান ডা. এ এফ এম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেছেন, কিডনি, লিভার এবং হার্টের সমস্যা থাকার পরেও হাসপাতালে থেকে যেন তিনি অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে না পড়েন, সে জন্য তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে ঢাকার বেসরকারি হাসপাতাল এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।ডা. সিদ্দিকী বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরেই সিটি স্ক্যান ও অন্যান্য ইনভেস্টিগেশন করে দেখা গেছে যে, ওনার বুকে পানি এসেছে। সেটি হার্ট ফেইলিওর সংক্রান্ত। করোনার একটি জটিলতা হলো যে, মানুষের হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।’

 

শনিবার রাতে খালেদা জিয়াকে বাসায় আনার উদ্দেশে হাসপাতাল থেকে বের করার পর পুরো চিকিৎসাকালীন যেসব জটিলতার মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি তার একটা বর্ণনা দেন ডা. সিদ্দিকী।

 

তিনি জানান, এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তির পর প্রথম তিন দিন তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তার ফুসফুসে সাইটোকাইন স্টর্ম (ফুসফুসের মধ্যে এক ধরনের ঝড়) শুরু হয়। এতে তিনি ফের জ্বরে আক্রান্ত হন। এ সময় তার বুকে পানি জমা হয়।ডা. সিদ্দিকী বলছেন, ‘আমরা ওই সময় দ্রুত পরীক্ষা করে দেখলাম যে তার বুকের দুই দিকে অর্ধেক পানি চলে আসছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় ওনাকে সিসিইউতে নিয়ে যাই। সেই সময় আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখা গেল, ওনার অর্ধেক বুক পানিতে ভরে যাচ্ছে এবং লাংস (ফুসফুস) সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা ওনাকে কৃত্রিমভাবে টিউব দিয়ে পানি বের করা হয়। তখন দেখা যায়, আসলে পানি না, স্রোতের মতো রক্ত আসছে।’প্রথমে বামদিকের, পরে ডানদিকের টিউব দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করল। ’

 

প্রায় ১৯ দিন ওনার বুকের দুই পাশে দুটি ব্যাগ ছিল, সেখানে সারাক্ষণ পানি আসছিল, বলছিলেন ডা. সিদ্দিকী।ভেন্টিলেশনে নেয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল একবারডা. সিদ্দিকী বলছেন, তাদের এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল খালেদা জিয়াকে ভেন্টিলেশন দিতে হতে পারে।আমরা ওনার পরিবারের এবং দলীয় সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি করতে হয়নি।

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খালেদা জিয়ার কিডনি এবং লিভারের সমস্যাও পাওয়া যায়।এসব বিষয় একসাথে মিশে ওনার সিরিয়াস অবস্থায় চলে গিয়েছিল। ‘স্টেবল’ কিন্তু পুরো সুস্থ নন তিনি । ব্রিফিংয়ে এইসব কথা বলেন খালেদা জিয়ার চিকিৎসক।

 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে তার পরিবারের সদস্যরা সরকারের কাছে আবেদন করেন।তবে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে ৯ই মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যেতে সরকার অনুমতি দেবে না। তখন বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যেতে দিচ্ছে না।

 

খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দল, এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা, আমেরিকান বিশেষজ্ঞ দল ও যুক্তরাজ্যে তার চিকিৎসক পুত্রবধূ এই চিকিৎসায় অংশগ্রহণ করেন।

 

সংক্রমণের কারণ হাসপাতালের জীবাণু
হাসপাতালে চিকিৎসার এক পর্যায়ে আবার সংক্রমণ হয় খালেদা জিয়ার, আবার জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। তবে সেটি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসে।ডা. সিদ্দিকী বলছেন, এ সময় ওনার কিডনি, লিভার এবং হৃদযন্ত্রের অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে যায়। সেগুলোর চিকিৎসা করে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সেই সঙ্গে কোভিড পরবর্তী জটিলতার চিকিৎসাও করা হয়।

ডা. এ এফ এম সিদ্দিকী বলছেন, ‘ওনার আথ্রাইটাইটিস, ডায়াবেটিস, প্রেশার, হাইপার টেনশনের চাইতেও ভিতরে ভিতরে কতোগুলো অসুখে আক্রান্ত ছিলেন, যেগুলো গত তিন-চার বছরে কোন চিকিৎসা বা পরীক্ষানিরীক্ষা হয়নি। কোভিড জটিলতার কারণে সেগুলো বেরিয়ে আসে।’

 

‘তার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, হাসপাতালে যেসব জীবাণু থাকে, সেগুলো তাকে আক্রমণ করছে। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, উনি যেখানে ছিলেন, নন কোভিড সেকশন, সেখানে দেখা যাচ্ছে কিছু ডাক্তার, নার্স ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ এ রকম পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানাচ্ছেন ডা. সিদ্দিকী।তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা চিন্তা করে তাকে বাসায় নিয়ে এসেছি।’

 

‘উনি স্ট্যাবল আছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। আমরা সবাই মিলে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে আপাতত তাকে বাসায় রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাবো।’ বলছেন ডা. সিদ্দিকী।

 

চিকিৎসকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার যে ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন, বিশেষ করে কিডনি ও লিভারের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, সেই টেকনোলজি বা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাংলাদেশে নেই।

 

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।দেশজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ ছয় মাসের জন্য নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এর পর প্রথমে সেপ্টেম্বরে ও পরে চলতি বছরের মার্চে আবারো ছয় মাসের জন্য তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।গত ১১ এপ্রিল খালেদা জিয়ার শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button