মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানিও পেলেন না জন্মদাতা বাবা, জিবনের ঘানি টানা স্বামি।
চট্টগ্রামের একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মী সাহাব উদ্দিন (৫৫)। শরীরে জ্বর-ব্যাথা নিয়ে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পেতে বাড়ি গিয়েছিলেন গত বুধবার। শনিবার তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, জ্বরও বেড়ে যায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসা ছিল সাহাব উদ্দিনের ‘ক্ষমার অযোগ্য’ মস্তবড় এক অপরাধ! এর শাস্তিস্বরূপ প্রাণধিক প্রিয় স্ত্রী আর কলিজার টুকুরাসন্তানরা তাকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
ভেতরে আটকে পড়া সাহাব উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে দরজা খোলার অনেক আকুতি জানান। প্রচণ্ড ক্ষুধায় খাবার চান। তৃষ্ণা মেটাতে পানির জন্য হাহাকার করেন। কিন্তু তার ভুলটা এত বেশি যে, কোনো আবেদনই মঞ্জুর হয়নি তারই স্ত্রী-সন্তানদের কাঁছে।
গত রবিবার রাতের কোনো এক সময়ে আবদ্ধ রুমে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান সাহাব উদ্দিন। সারাজীবন যাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, সেই মানুষগুলোকে জীবন সায়াহ্নে পাশে তো পেলেনই না, পেলনা এক চামচ পানিও।
অথচ সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল কি-না সেটি তখনও নিশ্চিত না। সেদিন সকালেই তিনি নমুনা দিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে। স্ত্রী-সন্তানেরা এই নিষ্ঠুরতা না করলেও পারতেন।
সাহাব উদ্দিনের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভাদাদিয়া গ্রামে। স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও তিন জামাতা তার। দুই ছেলে কাজের সূত্রে গ্রামের বাইরে থাকেন। মৃত্যুর সময় অন্যরা বাড়িতেই ছিলেন।
ইউপি চেয়ারম্যান রবিউজ্জামান জানান, হাসপাতাল থেকে আসার পর পরিবারের কেউ সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেননি। দুপুরে তাকে খাবারও দেননি। বিকেলে শ্বাসকষ্ট ও কাশি বেড়ে যায়। এ সময় তিনি চিৎকার করে খাবার চাইলেও কেউ দেননি। পানিও পাননি। তাকে শয়নকক্ষে তালা লাগিয়ে রাখেন পরিবারের সদস্যরা। ছোট ছেলেটি এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে বোনেরা বাধা দেন। এভাবে চিৎকার করতে করতে রাত ১০টার দিকে সাহাব উদ্দিনের মৃত্যু হয়। রাতে সাড়াশব্দ না পেয়ে পরিবারের লোকজন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন তিনি মারা গেছেন। এরপর সবাই যার যার ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে যান। পরে ছোট ছেলে ‘বাবা মারা গেছে’ বলে চিৎকার শুরু করেন।
সরেজমিনে দেখা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ইউপি সদস্য ফেরদৌস রাসেল বলেন, ‘বাড়ির একটি কক্ষে সাহাব উদ্দিনকে রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। ছিটকিনি খুলে আমরা ভেতরে বিভৎস দৃশ্য দেখতে পাই। সম্ভবত সাহাব উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট উঠেছিল এবং তিনি তা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি করেছিলেন। তার পরনের কাপড় খোলা অবস্থায় পাশে পড়েছিল।’ পরে তারা দাফনের ব্যবস্থা করেন। পরিবারের কেউ আসেনি।
এমন না যে পরিবারের একজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলেই একে একে সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এমন না যে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শরীরে স্পর্শ লাগামাত্রই আপনি আক্রান্ত হয়ে যাবেন! সাহাবউদ্দিনকে ঘরে আটকে রেখেছেন ভালো কথা, বাইরে থেকে তাকে খাবার তো দেওয়া যেত।
স্বামী-স্ত্রীর সহমরণের কত নজির রয়েছে। বাবার জন্য সন্তান, সন্তানের জন্যে বাবা নিজেকে বলিদানের কত নজির। কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ দেখছি, যেখানে এতটা নিষ্ঠুর পরিবার স্ত্রী-সন্তানেরও দেখা মিলছে?