শিক্ষাঙ্গন

কথার কথকতা – মাইন উদ্দিন আহমেদ

নিউজ জাতীয় বাংলাদেশ

কথার কথকতা
– মাইন উদ্দিন আহমেদ

পত্রিকা জগতে প্রাতিষ্ঠানিক মান গড়ে ওঠার পেছনে ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ত্বের এক বড় ধরনের ভূমিকা থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলতে গেলে বলার একটা অধিকার আমার বোধের মধ্যে কাজ করে। তাই এই বিষয়ে সাহস করে কলম ধরলাম।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি ছিলো দৈনিক আজাদ এবং মাসিক মোহাম্মদী। যাঁর কারনে এই শিরোনাম দুটো একটি যশস্বী সাইনবোর্ডে গড়ে উঠেছিলো তিনি হলেন মাওলানা আকরম খাঁ। ওনাকে আমি দেখিনি। কলেজ জীবনে ডাকযোগে যখন আমি আজাদ পত্রিকার গ্রাহক তখন সম্ভবতঃ পত্রিকাটি ওনার ছেলেদের হাতে। তবে ওনার সময়কার অনেকগুলো মাসিক মোহাম্মদী আমার পিতার সংগ্রহে পেয়ে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি। আশীষ কুমার লোহ, জহির রায়হান এবং ওনাদের সমবয়েসী লেখকরা ঐ ম্যাগাজিনে তখন উঠতি লেখক। তখনই চাররঙ্গা প্রচ্ছদে ওটি ছাপতো। এসব নিয়ে পরে এক সময় বিস্তারিত হবে। এখন শুধু সম্পাদক কি করে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করেন সেটুকু সংক্ষেপে দেখা যাক।

প্রজ্ঞা এবং ম্যানারিজম একজন মানুষকে প্রতিষ্ঠানে পরিনত করে। এর সাথে মিডিয়ার সম্পৃক্ততা থাকলে সেটি সাইনবোর্ড হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা আছে এরকম চারজন সম্পাদক সম্পর্কে বলবো, খুব সংক্ষেপে, যদিও এটি অনেক বড় করে লেখার বিষয়।

বাংলাদেশ অবজারভার সালাম সাহেবের হাতে উদাহরণ হয়ে উঠার পর এলেন ওবায়দুল হক সাহেব। এই পত্রিকার কর্মী হবার পর জানলাম, খান বাহাদুরের ছেলে, পান্ডিত্যপূর্ণ এই ব্যক্তিটি সবচেয়ে সহজ করে ইংরেজী লিখতে পারেন যেটি সবচেয়ে কঠিন কাজ। কাজ করতে গিয়ে পান্ডিত্যের সাথে তাঁর সৌজন্যমন্ডিত ব্যবহার অর্থাৎ ম্যানারিজম-এর যেই পরিচয় পেলাম তা ছিলো অসাধারন।

একটা ছোট্ট উদাহরন দেই। এক রাতে তিনি কমপিউটার ইনচার্জকে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন কে আছে। এরপর ফোনের রিসিভার আমার হাতে। সালাম দিয়ে বললাম, স্যার, আমি মাইন উদ্দিন। তিনি অনুরোধ করলেন, আমি যেনো আজকের প্রক্রিয়াধীন সম্পাদকীয় পাতাটা হাতে নিই। বললাম, স্যার এটি আমার হাতেই আছে। তিনি খুব মিষ্টি করে বললেন, “আচ্ছা মাইন উদ্দিন, অমুক শব্দটার বদলে তমুক শব্দটা দিলে কেমন হয়?”
আমি উত্তর দিলাম, জ্বী স্যার, ভালো হয়। তিনি বললেন, “তাহলে একটু বদলে দেন, প্লীজ।”
এরপর কি ওনার সম্পর্কে আর কিছু বলা লাগবে?
অবজারভারের সৌভাগ্য যে, প্রতিষ্ঠানটি এরপর মুনীম সাহেবের মতো আরও একজন ভদ্রলোককে সম্পাদক হিসেবে পেয়েছে।

এবার বলতে চাই দেনিক বাংলার বিখ্যাত সম্পাদক নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী সাহেব সম্পর্কে যিনি ‘নূইপা’ নামে কলাম লিখতেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কি বলেন জানিনা তবে ওনাকে আমি সৌজন্যমন্ডিত মানুষ হিসেবে দেখেছি। আমার আব্বার সহপাঠি ছিলেন তিনি স্কুল জীবনে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ শেষ করার পর দেখা করলাম। বললেন, একটা সিভি দিয়ে যেয়ো। কিন্তু পরের মাসেই তিনি চাকুরীচ্যূত হলেন এবং কাছাকাছি সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলেন এবং বেশ কষ্ট পেয়ে পরপারে চলে গেলেন। দৈনিক বাংলা এবং বিচিত্রা এদুটার প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভের ক্ষেত্রে ওনার ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। পেশাগত যোগ্যতা, জ্ঞান এবং সৌজন্য ওনাকে যশ দিয়েছে।

এবার আসি সানাউল্লা নূরী সাহেব সম্পর্কে। ওনার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের আমি কতটুকুইবা দেখেছি! যেটুকু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাতে বলা যায়, দৈনিক দিনকাল এবং দৈনিক দেশ এ দুটো পত্রিকার নাম উচ্চারন করলেই ধ্বনিত হয় ওনার নাম। তিনি নোয়াখালীর সন্তান আর ওনার বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠি ছিলো যার জামাতাও আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বললেন, তোমার লেখা হেলাল হাফিজকে দিও, ও তোমাকে সম্মাণীও দেবে। কয়েকবার তিরিশ ও পঁচিশ টাকার বিলও পেয়েছিলাম।
একদিন বললেন, মাইন উদ্দিন, শুনলাম তুমি নাকি এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছো, এক কাজ করতো, মধ্যযুগের সাহিত্যের উপর একটা পরিপূর্ণ লেখা তৈরী করে আমাকে দাওতো। অনেক খেটে লেখা তৈরী করে ওনাকে দিয়েছিলাম। ওনার এক স্নেহাষ্পদের পত্রিকায় ওই লেখা এক পূর্ণ পৃষ্টারও বেশী স্হান জুড়ে ছেপেছিলো। কপি রাখতে পারিনি। যা-ই হোক, ওনার বন্ধুরা নাকি ওনাকে মেজাজী লোক বলে জানতেন কিন্তু আমি পারিবারিক পরিসরেও ওনাকে যৌক্তিক মানুষ হিসেবে দেখেছি। ওনার প্রস্হানের পর ঐ পত্রিকাগুলো আর ভালো করতে পারেনি।
আর একজনের কথা না বললে আমি আমার বিবেকের কাছে দায়ী থেকে যাবো।

আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু বিদেশে একটা পত্রিকায় অনেকদিন কাজ করার পর সম্প্রতি স্হায়ীভাবে ঢাকায় ফিরেছেন। ফোনে কথা হচ্ছিলো, কি করবে এসব বিষয় নিয়ে। বললো, দুটো পত্রিকায় কাজ হবার সম্ভাবনা আছে। পত্রিকাগুলোর নাম জানার পর আমি আমার এখনকার আলোচনার বিষয় যিনি সেই সম্পাদকের পত্রিকায় জয়েন করতে পরামর্শ দেই। আমার বন্ধু কারন জানতে চাইলো। আমি বললাম: তিনি প্রফেশনালিজমে বিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো এই যে, যারা ওনার দ্বারা বেশী উপকৃত হয়েছে ওরাই এক সময় ওনার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অথচ আমি দেখেছি তাঁর পেশাভিত্তিক দৃঢ়তা। যা-ই হোক, তুমি শুধু ওনার পেপারেই যোগ দেয়ার চেষ্টা করো। কারন ওনার মধ্যে একটি সমৃদ্ধ মানবিক সত্ত্বা এবং পেশাদারিত্ত্ব বিরাজমান।

এই সম্পাদকের নাম হচ্ছে ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বর্তমানে ডেইলী অবজারভার-এর সম্পাদক। তিনি সব সময়ই সৌজন্য এবং পেশাগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে কথা বলেন। কাউকে অসম্মান করে কথা বলেননা। সম্মান জানাই মানবিক গুণবিশিষ্ট সম্পাদকবৃন্দকে। বিধাতার কাছে কল্যাণমূলক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ব্যক্তিবর্গের দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button