কবিতাগুলো লিখেছেন জাহানারা বুলা
– মাইন উদ্দিন আহমেদ
কবিতার সেবক হিসেবে আমার নিউ ইয়র্ক পর্ব নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। সাথে আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার কঠিন সাধনার ফল যুক্ত হওয়ায় নতুনত্ত্বের ঝলক একটু বেশিই আলোকময় হচ্ছে বলে মনে হয়।
না, আমার নিজের কথা বলার জন্য বসিনি আজ। কবিদের কথা বলবো। পটভূমিটা তুলে ধরি।
নতুন বছরের একুশে বইমেলা, কাজী জহির সাহেবের উপস্হাপনায় দুটো সাহিত্য বিষয়ক অনলাইন স্ট্রিমিং এবং নবযুগ পত্রিকা কর্তৃক নতুন বই নিয়ে কলাম মুদ্রণ, সব মিলিয়ে নতুন একটা আবহ যা অনেককে আগ্রহী ও গতিময় করে তোলে।
তবে আজ আমরা অভিমত ব্যক্ত করবো কয়েকটি কবিতার উপর যেগুলো লিখেছেন কবি জাহানারা বুলা।
‘কফি ও কবিতা’ এবং ‘বই কথা কও’ এই দুটো হলো কাজী জহির সাহেবের সাহিত্য বিষয়ক দুটো অনলাইন মঞ্চ যেখানে অন্যান্য অনেক কবির মত কবি জাহানারা বুলাকেও দেখা গেছে। আমরা ওনার কথা শুনেছি। ফেইসবুকে কিছু কবিতা পড়ারও সুযোগ হয়েছিলো। এরই ফলশ্রুতিতে সাহিত্যের ছাত্র এবং সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এই কবির লেখায় বিশেষ কিছু যেনো অনুরণিত হচ্ছে। সেটা কি? তা হচ্ছে, কবি কি রোম্যান্টিক না কি রিয়্যালিস্টিক এটা বুঝবার চেষ্টায় একটা কাব্যিক আহ্বান। একই কবিতায় কবিকে রোম্যান্টিকও মনে হয়, রিয়্যালিস্টিকও মনে হয়! এরকম হওয়াটা অভিনব। তাই এই কবিকে নিয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম।
এরই মধ্যে নববর্ষের বই মেলায় ওনার দুটো বই এসেছে। বই দুটো হলো ‘ধূসর রঙের পাখি’ এবং ‘আলোহীন অন্ধকারে’। এর মধ্যে ‘ধূসর রঙের পাখি’ বইটির কিছু কবিতা আমার পড়বার সুযোগ হয়েছে যেগুলোর আংশিক এ লেখার পাঠকবৃন্দের সাথে আবার পড়ে নেবো। আমার বিশ্বাস, এভাবে আমরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারবো।
জাহানারা বুলা কর্তৃক রচিত কবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি মনের ভাব কাব্যাকারে প্রকাশকালে স্পষ্ট, সৎ এবং বলিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেন এবং তা একজন লেখকের ঐজ্জ্বল্য নির্দেশক। কোন কোন খুবই সম্ভাবনাময় কবিকে দেখা যায়, তিনি প্রচুর কাব্যালঙ্কার ও সাহিত্যরস গুলিয়ে তাঁর লেখার মধ্যে ছুঁড়ে দেন এবং এমন একটা মনোভাব দেখান যে, এগুলো যথাস্হানে বসিয়ে বুঝে নেয়া যেনো পাঠকেরই দায়িত্ত্ব। কেনো, পাঠকের কি ঠেঁকা পড়েছে! বস্তুতঃ এ মনোভাবের লেখকগণ নিজেরাই নিজদের বৈরী। কবি জাহানারা বুলা তা করেননা। তিনি স্পষ্টভাবে সঠিক কথা সঠিক জায়গায় প্রয়োজনীয় আলঙ্কারিক ভঙ্গীতেই বলেন। এতে মাঝেমাঝে তাঁকে কিছুটা উদ্ধত মনে হয় কিন্তু আমরা মনে করি, সাহিত্যককেই সাহসী হতে হয়। বস্তুতঃ সাহিত্যিকের আজকের লেখাটিই আগামীদিনের মানবসমাজকে সঠিক নির্মিতির দিকে এগিয়ে নেয়।
যা-ই হোক, পাঠকবৃন্দ কবি জাহানারা বুলার কবিতার বই পড়ে কাব্য উপভোগের সাথে ওনাকেও আবিষ্কার করতে পারবেন। এখানে আমরা আমাদের পাঠ থেকে ওনার কবিতার কিছুকিছু অংশ উদ্ধৃত করবো।
‘আমি প্রেমিকা বলছি’ কবিতায় কবি বলছেন, “সব ছুঁয়েছুঁয়ে প্রেমের টক্সিনটুকুর প্রশ্রবণ করে দিয়ে গেলে/ওই বিষের কালিতেই যে কবিতা লিখি আমি।” পাঠক কি বিশ্লেষণ করতে পারে যে, এই কবি রোম্যান্টিক না কি রিয়্যালিস্টিক। মনে হয় যেনো, এ এক মিশ্রণ, কষ্টের ভেতরে বসে গাওয়া জীবনের গান।
‘আমি তা চাইনা’ কবিতায় কবি লিখছেন, “আমার ভালোবাসার যত অভিমান আমি সপ্তর্ষীমন্ডলে জমা করে/অনুভূতিহীন ক্যাশ করে নিয়েছি-/তাই দিয়ে কেটে যাবে বাকিটা জীবন।” নেতিবাচক পরিস্হিতিকে জয় করে এগিয়ে যাবার জন্য একটা অপরাজেয় গতি রয়েছে প্রচ্ছন্ন এই কাব্যাংশের মধ্যে।
‘হযবরল’ শিরোনামের কবিতায় পাঠক অল্প কথার মধ্যেই একটা চিত্র পেয়ে যাচ্ছেন। “কামরাগুলো বাসযোগ্য নয় মোটেই,/কোথায় বসতে দিই!/তার চেয়ে পায়ে হেঁটে চলো ওই দিকটায়/ ওখানে সাগর আছে।” জীবনের কামরাগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেলে সমস্যা নেই, এগিয়ে যাবার জন্য রয়ে গেছে বিশাল সমুদ্র তীর। কি অসাধারন হাঁ-সূচকতা!
‘কথা শেষ আছি বেশ’ কবিতায় জাহানারা বুলা বলছেন,”আমার ঝগড়ায় কি ভালোবাসা নেই?/আরো বেশি প্রেম চাই বলেইতো এতো বেশি অভিমান/তুমি কি আমার স্মৃতি রাখো মেসেঞ্জার বক্স ভরে।” আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম কাব্যবিষয় হয়ে চলে আসে অপরিহার্য বিষয় হয়ে।
‘অধরা মন’ কবিতায় আমরা পড়লাম, “তুমি যে বলেছিলে মন ছুঁয়ে থাকবে/ছুঁতে পারলে?/আমি কিন্তু ছুঁতে পারিনি কোন মন/শরীর ছুঁয়েছি জীবন্ত।” বাস্তবতা আর কল্পনার সমন্বয়ে অল্প কথায় চিত্রিত হয়ে যায় একান্ত জীবন।
‘দুষ্টু মেয়ে’ কবিতা ঘোষনা করছে, “ঠিক এরকম প্রেম চাই/যেরকম প্রেমে কেউ বকবেনা আর/থাকবেনা ভয় লোকলজ্জার।”
কবিতা ‘অর্ধেক প্রেম’ লিখছে, “ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়া জরুরী হলে/তাও যাবে চলে?/চলে যেতে চাও কেন অর্ধেক প্রেমে?” যে কোন অবস্হায় সচেতন বিবেচনায় কবি ঝুঁকে থাকেন জীবন অভিমুখে।
‘মোহনা’ কবিতায় কবি যখন বলেন, “ভালোবাসা কত রূপে আমাকে শুধাও/এক এক করে ব্যাখ্যায় কেটে যাবে কাল”, তখন জীবনের বিপরীতমুখী হওয়া বা জীবন থেকে পলায়নের রাস্তা খুঁজবার বা বিরহে লুটিয়ে পড়ার প্রয়োজন হয়না। কবির কি দারুণ জীবনমুখীনতা!
কবি জাহানারা বুলা যে সব কবিতা লিখেছেন তার সবটাই জীবনকে এর বাস্তবতার নিরিখে সুখ-দুঃখ সমেৎ চিত্রায়িত করে এক দৃঢ় ও আশাবাদী মন ও মননে জীবনের মধ্যেই টিকে থাকার এক উদ্দীপনাকে লালন করছে। এই কবির লেখা পাঠককে আমাদের কবিতা সম্পর্কে আরো উৎসাহী করে তুলবে, এটা আমাদের বিশ্বাস।
আমাদের কঠিন জীবনে আপনার কবিতা অনুপ্রেরনা হয়ে আসতে থাকুক, এই ইচ্ছা ব্যক্ত করে আমরা অনুরোধ করবো, আপনি আপনার কাব্য সৃজন প্রক্রিয়া চালু রাখুন। আপনার কবিতায় স্বকীয়তা বিদ্যমান।