এটাও কাজী জহিরুল ইসলাম-এর বই
— মাইন উদ্দিন আহমেদ
বইয়ের নাম ‘উত্থানপর্বের গল্প’। এটাও কাজী জহিরুল ইসলামের বই। বিষয়বস্তু হলো, ভাষা শহীদদের সার্বিক কাহিনী। একটা সম্পূর্ণ নতুন আবেদন নিয়ে নতুন ব্যতিক্রমধর্মী লেখার ধারায় এসেছে বইটি। ইতিহাস কিভাবে গল্পসজ্জিত হয়ে নতুন একটা সমৃদ্ধ রূপ লাভ করতে পারে এ বই না পড়লে বুঝা যাবেনা।
ইতিহাস, সমাজ ও জ্ঞানের কোন পরিপ্রেক্ষিতে কাজী জহির সাহেবের এ বই জন্ম নিয়েছে তার উপর একটু আলোকপাত করা যাক।
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে ধারনা আছে কেমন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু লোকের সাথে আলাপ করে দেখা গেছে, আমাদের আসলেই তেমন কোন স্পষ্ট ধারনা নেই। কেউ বলে শহীদ মিনার, কেউ বলে একুশে ফেব্রুয়ারী, কেউ বলে “আমি কি ভুলিতে পারি” ইত্যাদি ইত্যাদি। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও ভাষা শহীদদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে “রফিক, সফিক, জব্বর, বরকত” পর্যন্ত বলে থেমে যান। যদি বলা হয়, সফিক নয়, তিনিতো সফিউর, উত্তর আসে, জানতামনাতো! আসলে ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা শহীদদের সম্পর্কে গড়পড়তা ধারনা গড়ে উঠবার উৎস হলো, একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপনের সময় মাইক থেকে ভেসে আসা কথাগুলো। শিক্ষিত থেকে অল্পশিক্ষিত পর্যন্ত একুশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যেটুকু ধারনা কাজ করে তা একটু কাব্যি করে বললে এরকম দাঁড়ায়:–
জিন্না সাব দিলেন ভাষণ একখান/ উর্দু উইল বি রাষ্ট্রভাষা অফ পাকিস্তান/ প্রতিবাদ হলো মিছিলে হাত তুলি/ পুলিশের লোক মারলো অনেক গুলি/ বুক হলো ছিদ্র উড়লো মাথার খুলি/ পরাজিত হতে রাজী নয় মায়ের বুলি/ সমবেত কন্ঠে ভাষাসঙ্গীত হলো জারী/আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।
এতোক্ষণ যেই ভূমিকার অবতারনা করা হলো তার মূলে কাজ করেছে একটি বই। এই বইটাও কাজী জহিরুল ইসলাম-এর যিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখেছেন সত্তুরেরও অধিক সংখ্যক বই! এ বইয়ের নাম, ‘উত্থানপর্বের গল্প’। দেওয়ান আতিকুর রহমানের পরিশীলিত প্রচ্ছদে পুরু কাগজে ছেপে এনেছে অগ্রদূত এ্যান্ড কোম্পানি। চলতি বইমেলাতেও বাংলা একাডেমীতে পাওয়া যাচ্ছে।
বইটি অতি সম্প্রতি আমার হাতে আসার পর মনে হলো, আরো আগে হাতে আসা দরকার ছিলো।
বইয়ের সূচী থেকে ভাষা শহীদদের নাম সঠিকভাবে জানলাম। ওনাদের নাম হচ্ছে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, সফিউর, অহিউল্লা এবং আউয়াল।
কাজী জহির সাহেবের বইটিতে ভাষা শহীদদের বিষয়টা সংক্ষিপ্ত গদবাঁধা বর্ননায় শেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাসের সাথে গল্পের মিশ্রণ এবং প্রচ্ছন্নভাবে সামাজিক অবস্হা-নির্ভর যুক্তি-বাস্তবতা কাহিনীতে যেভাবে প্রোথিত হয়েছে তা হৃদয়কে এক করুণ সুরে গেঁথে ফেলে। ভাষা শহীদ হয়ে ওঠেন একান্ত আপনজন!
‘উত্থানপর্বের গল্প’ বইটিতে কাজী জহিরুল ইসলাম সাহেব ইতিহাসের সাথে গল্পের একটা আত্মীয়তা সৃষ্টি করেছেন কিন্তু কাজটা করেছেন অনেক দক্ষতার সাথে। গল্প এবং ইতিহাস যাতে পরস্পরের জন্য ক্ষতিকর না হয় সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সদা সচেতন।
লেখকের সাথে পাঠক যখন একজন ভাষা শহীদের দেশের বাড়িতে যান এবং পারিবারিক বিষয়ে একাত্ম হয়ে ওঠেন তখন বিষয়টি অনন্য হয়ে মাথা তোলে। এসব সংগ্রহে লেখককে কষ্ট করতে হয়েছে প্রচুর এবং ঐতিহাসিক দলিলসমূহ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও যে তিনি অনেক খেটেছেন তা সচেতন পাঠক মাত্রই ধরতে পারবেন। আর গল্প ও ইতিহাসকে একই আধারে ব্যবহারের যোগ্যতা একজন অসাধারন মেধাবী মানুষই রাখেন, এতে কোন সন্দেহ থাকেনা।
ভাষা শহীদদের সম্পর্কে এবং ভাষা আন্দোলনের উপর পরিপূর্ণ এবং স্পষ্ট ধারনা পাবার জন্য এই বইটি প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষের পাঠ করা উচিত। লেখার অসাধারন ভঙ্গীর জন্য পাঠক গল্পচ্ছলে ইতিহাসও পড়ে ফেলতে পারবেন, এটা নিশ্চিত।
বইটির শেষ প্রচ্ছদ বলছে, “ভাষা আন্দোলন বাঙালির চেতনার সূতিকাগার। যারা এই সূতিকাগারের স্রষ্টা তারাই আমাদের জাতিসত্তার উত্থানপর্বের নায়ক। এই সাত নায়কের গল্প তাই বাঙালির ‘উত্থানপর্বের গল্প’।
এই বই উপস্হাপন করার কাজটি এতো অল্প কথায় সম্পন্ন হয়না, অনেক দীর্ঘ লেখার প্রয়োজন হয়। আমরা এখানে শুধুমাত্র পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো, পড়তে খুব বেশি সময় লাগবেনা এবং বইটি না পড়লে ইতিহাসের গল্প পড়ার মজা থেকে সত্যিই বঞ্চিত হবেন। তাই আসুন পড়ি ‘উত্থানপর্বের গল্প’।