শিক্ষাঙ্গন

“মনে পড়ে জবির লাল বাসকে”

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ, জবি প্রতিনিধিঃ

“মনে পড়ে জবির লাল বাসকে”

ঢাকার স্নিগ্ধ সকালগুলোতে আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল ভার্সিটির লালবাস। খুব ভোরে যখন নগরীর ব্যস্ততায় প্রাণ আসেনি, ঘুম থেকে উঠে পনে ছয়টার মধ্যে বাসা থেকে বের হতাম, ভার্সিটি বাসটা যে ধরতেই হবে!

সাতটার মধ্যেই কুয়াশা ঠেলে দারুস সালামে আসত আমার লালবাস, উত্তরণ-১। যেহেতু আমি ফাস্ট ইয়ারে অর্থাৎ ভার্সিটিতে জুনিয়র তাই বাসে বেশ কিছু সামাজিকতার মাঝ দিয়ে আমাকে যেতে হতো। আর এই সামাজিকতাগুলোই আমার ভীষণ ভালো লাগতো। বাসে উঠেই বড়দের সালাম করা, বড় আপু দাঁড়িয়ে থাকলে তাঁকে বসতে দেয়া, সবার সাথে নিজের পরিচয় করিয়ে নেয়া-এসবই ছিল আমাদের নিত্যদিনের সামাজিকতার অংশ।

সবার মিষ্টি হাসি, গল্পের ছড়াছড়ি, গান, আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় সবকিছু খুব উপভোগ করেছি। কত খাবার (বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, আমড়া, পেয়ারা, আচার) সবার সাথে ভগাভাগি করে খেয়েছি, বড় আপুদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি।

মাঝে-মাঝে অনেকে অভিনয় করতো, কখনো হরাক সেজে আবার কখনো আমড়া-পেয়ারা-বাদাম বা ইঁদুর-তেলাপোকার ঔষধ বিক্রেতা সেজে, এতে পুরো বাসে যেন হাসির বন্যা বয়ে যেত। আর এই অভিনয়গুলো মূলত প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরাই করত। বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র তো বটেই সহপাঠীদের সাথেও পরিচিত হতে খুব ভালো লাগত। এ ছিল জগন্নাথের সব বিভাগ সম্পর্কে জানার এক সুবর্ণ সুযোগ! তাঁদের বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতাম, আমাদের বিভাগের কথা শেয়ার করতাম। আমার এই নতুন পরিবেশটাতে সবাই খুবই অমায়িক ছিল।

সাধারণত বাসের প্রথমাংশে মেয়েরা আর শেষাংশে ছেলারা বসে। আর অধিকাংশ সময় বাসের শেষের দিকটা থেকেই ভেসে আসত-শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’র মতো আমার কিছু প্রিয় গান। ভাইয়ারা গাইত, সাথে-সাথে আপুরাও, একসময় পুরো বাস সুর মেলাত এইসব গানে। বিশেষ করে ফেরার সময়, জ্যামে পড়ে যখন পরিশ্রান্ত লাগত তখন গানগুলো, বিশেষ করে ফেরার সময়, সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিতো, জ্যামকে তখন মোটেও বিরক্তিকর লাগত না। সেই সাথে ক্যাম্পাসের সবার দিনব্যাপী কার্যক্রমের অভিজ্ঞতাগুলো শুনতেও বেশ ভালো লাগত।

মাঝে-মাঝে আপুদের সাথে বসতাম দরজার সিঁড়িতে, এটাও ছিল এক হৃদয় ছোঁয়া মিষ্টি অনুভূতি!

এছাড়াও আমাদের সমাজসেবী জবিয়ান ভাইদের পথচলতি সময়ে দায়িত্ববোধের জন্য খুব গর্ব হতো তখন তাঁদের নিয়ে। প্রায় সবদিনই বাসে প্রচুর ভীড় থাকত, বিশেষ করে দরজাগুলোতে এই ভীড় প্রকট হতো। অনেক শিক্ষার্থীকেই দাঁড়িয়ে যেতে হতো। এমতাবস্থায়, বাসের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার বিষয় ছিল একটি নিয়ম। তা হলো- অর্ধেক রাস্তা যাঁরা বসে এসেছে, তাঁরা বাকি অর্ধেক রাস্তা দাঁড়িয়ে যাবো, আর এতক্ষণ যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিল, তাঁদের বসতে দিবে, এই আসন বিনিময়টা শাহবাগে এসে হতো।

এইভাবেই কাটতো ভার্সিটি বাসে আমার রোমাঞ্চকর মুহুর্তগুলো। দিনশেষে ৬টায় যখন আবার দারুসসালামে নেমে বাসায় ফিরতাম, তখন শারীরিকভাবে ক্লান্ত হলেও মানসিকতায় ছড়িয়ে থাকত “আমার প্রিয় ক্যাম্পাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়” আর “উত্তরণ-১” এর কিছু প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি। আজকের এই করোনাকালীন সময়ে খুব বেশি মনে পড়ছে সেইসব দিনের কথা সকাল ৭টায় বাস মিস না করার প্রয়াস, আর বিকেল ৩টায় সারি-সারি বাসের ভীড়ে আমার প্রিয় উত্তরণ-১ কে!

মোছাঃ রুকাইয়া মিজান মিমি
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button