রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা
ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গির কবীর
রোজার উপকারিতা অপরিসীম। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। উন্নত বিশ্বে ‘ফাস্টিং’কে থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রায় ৮০টি রিসার্চের আলোকে ‘ফাস্টিং’ বা রোজার উপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে আমি একটি ভিডিও বানিয়েছিলাম। আজ চেষ্টা করব, সেই উপকারিতাগুলো সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরার।
অটোফেজি : অটোফেজি আবিষ্কারের মাধ্যমে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওসুমি নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এর বাংলা আত্মভক্ষণ। অর্থাৎ এটি আমাদের শরীরের পুরাতন প্রোটিনগুলোকে রিসাইকেল করে নতুন প্রোটিন তৈরি করে। আমরা যেমন ভাঙা ব্যবহার অযোগ্য কাচগুলোকে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে নতুন কাচ তৈরি করি। তেমনি রোজা রাখলে শরীরে রিসাইকেল (পুনঃব্যবহারযোগ্য) প্রক্রিয়া চালু হয় এবং ক্লিনজিং (পরিষ্কার) প্রক্রিয়া চালু হয়। অর্থাৎ আমাদের শরীরের যে টক্সিনগুলো (বিষাক্ত পদার্থ) জমা হচ্ছে, রোজার মাধ্যমে সেগুলো ডিটক্সিফিকেশন (বিষমুক্ত) হয়। আমরা কোষের ভেতর যে বর্জ্য পদার্থগুলো জমিয়ে রাখি (যেগুলোকে শোধন করার সুযোগ হয় না), পাশাপাশি প্রতিদিন আমাদের শরীরে যে ডিফেক্টিভ প্রোটিনগুলো (অব্যবহারযোগ্য প্রোটিন) তৈরি হয়, রোজা রাখলে আমাদের শরীর সেগুলোকে পরিষ্কার করার সুযোগ পায়। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে অটোফেজির মাধ্যমে এই ক্লিনজিং (শোধন প্রক্রিয়া)-গুলো হয়।
মেদ কমে : এ ছাড়া দীর্ঘ সময় রোজা রাখার মাধ্যমে আমাদের মেদ কমে। আগে আমরা চলতাম গ্লুকোজ থেকে শক্তি নিয়ে। কিন্তু রোজার সময় যখন আমরা না খেয়ে থাকি, তখন আমাদের শরীর ফ্যাট বার্নিংয়ের (অপ্রয়োজনীয় চর্বি পুড়িয়ে) মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করে; যাকে আমরা বলি কিটোন দিয়ে চলা (কিটো), এর ফলে আমাদের শরীরে জমে থাকা অপ্রয়োজনীয় চর্বি বার্ন (পুড়িয়ে) করে আমরা চলি, জমে থাকা চর্বি শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং আমাদের ওজন কমে যায়। আমরা জানি, অনেকগুলো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওজন কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
গ্যাস্ট্রিক কমে : অনেকের ধারণা রোজা রাখলে এসিডিটি বাড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো রোজা রাখার মাধ্যমে এসিডিটির সমস্যা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমরা যখন দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকি, তখন ইন্টেস্টিনাল স্টেম সেলগুলো (Intestinal stem cell) গ্রো করে (তৈরি হয়)। এবং আমাদের পেটের আলসার হিলিং হয়, লিকি (Leaky) গাটস
(Guts) ভালো হতে সহায়তা করে। এবং অ্যালার্জি থেকে আমাদের রক্ষা করে; অনেকেই হয়তো জানে না যে লিকি গাটসের কারণে অ্যালার্জি হয়। যে জীবাণুর কারণে পেটের আলসার হয় তার নাম হেলিকোব্যাক্টর পাইলেরি (H. Pylori) এই জীবাণুকে ধ্বংস হতে (Eradication) সাহায্য করে অটোফেজি।
ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করে : মূলত ক্যান্সারের সেলগুলোর প্রধান খাদ্য হলো গ্লুকোজ। গ্লুকোজ অনেকগুলো ব্যাকটেরিয়ার মিডিয়া, অর্থাৎ বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গ্লুকোজ জাতীয় খাবারগুলো ক্যান্সার সেলগুলোকেও বাড়তে সহায়তা করে। আমরা যখন দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি তখন অটোফেজির মাধ্যমে ক্যান্সার সেলগুলো আকারে ছোট হয়, টিউমারগুলোও (রিগ্রেশন) ছোট হয়ে যায়। এর পাশাপাশি আমরা যদি ব্যায়াম করি তাহলে প্রাকৃতিক কিলার সেলগুলো (NKC natural killer cell) উৎপন্ন হয় যেগুলো ক্যান্সার সেলগুলোকে ধ্বংস করে এবং না খেয়ে থাকলে আমাদের গ্রোথ হরমোন বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে অটোফেজির মাধ্যমে শরীরের খারাপ উপাদানগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। আবার শরীরের জন্য ভালো উপাদানগুলো উৎপন্ন করতে সহায়তা করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : রোজা রাখার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যারা প্রাথমিক রোগী (প্রি ডায়াবেটিক), টাইপ ২ ডায়াবেটিক তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বিনা ওষুধে আর যাদের ইনসুলিন নিতে হয় (IDDM), তাদের ইনসুলিন নেওয়ার মাত্রা কমে আসে।
হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ : হৃদরোগের প্রধান কারণ হলো রক্তনালিতে চর্বি জমে যাওয়া, হার্টে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া। সাধারণত শরীরে চর্বি জমে যাওয়ার কারণে এ ধরণের ঘটনাগুলো ঘটে। উচ্চ রক্তচাপ ও ওজন বেড়ে যাওয়াও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোজার উপকারিতা আছে। রোজা যেমন রক্তনালিগুলোকে পরিষ্কার হতে, শরীর থেকে চর্বি গলে যেতে সাহায্য করে; তেমনি, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। যা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য খুবই উপকারী।
কিডনি ভালো রাখে : কিডনির কাজ হলো শরীরের ময়লা আবর্জনাগুলো থেকে রক্তকে পরিষ্কার করা। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, তখন কিডনি তা করার সুযোগ পায়। পাশাপাশি কিডনি বিশ্রাম করার সুযোগ পায়।
লিভার : বর্তমান সময়ে ফ্যাটি লিভার একটি সমস্যা। রোজার মাধ্যমে আমরা ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্ত হতে পারি। লিভারও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় রোজা রাখলে।
দীর্ঘ যৌবন লাভ : অনেক গবেষণায় দেখা গেছে রোজার মাধ্যমে দীর্ঘায়ু লাভ করা সম্ভব। আসলে কথা হলো এর মাধ্যমে আমরা আমাদের যৌবন ও তারুণ্য দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারি। কারণ রোজার মাধ্যমে শরীরে নতুন সেল (কোষ) তৈরি হয়। পাশাপাশি আমাদের লিভার, হার্ট, কিডনি, ব্রেইন যখন পরিষ্কার থাকবে, তখন আমাদের মনে হবে যে আমরা আবার তরুণ বয়সে চলে গিয়েছি। রিসার্চে দেখা গেছে রোজা দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে অমরহম process-কে Delay (দেরি করানো) করে, রিভার্স (reverse) করে।
স্ট্রোকের আশঙ্কা কমে : আমাদের হার্ট ও ব্রেইনের রোগ হওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম অর্থাৎ রক্তনালিতে চর্বি জমা অক্সিজেন কম পাওয়া। ফলে রোজার মাধ্যমে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যায়। রোজা ব্রেইন টিউমারকে ছোট করতে সহায়তা করে।
এ ছাড়া রোজার মাধ্যমে আমাদের শরীরে যে অটোফেজি হয় তার মাধ্যমে স্মৃতিভ্রষ্টজনিত রোগ, বাত ব্যথা (Arthritis), অ্যাজমা ইত্যাদি রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ ছাড়া নতুন কোষ উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের ত্বককে করে মসৃণ ও রোগমুক্ত।
সবশেষে, বলব বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একমাত্র রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাই আপনাকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে। রোজা রাখলে Immune system boosting হয়, অর্থাৎ আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহর পুরস্কার : সবচেয়ে বড় কথা হলো রোজার মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাব। মহান আল্লাহ রোজার পুরস্কার নিজ হাতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। (নাসায়ি, হাদিস : ২২১৭)। অতএব রোজার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জাহানের উপকারিতা অর্জন করতে পারব।