জেলার খবর

৪৫ হাজার গরু-ছাগল নিয়ে দিশেহারা কৃষক-খামারি।

তানভীর ইসলাম রাজু,বগুড়া প্রতিনিধি-ঃ

৪৫ হাজার গরু-ছাগল নিয়ে দিশেহারা কৃষক-খামারি

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের দুর্গম হাটবাড়ি চরে যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে টিনের বেড়ার ঘরে বসবাস গণি সরকারের। যমুনা নদীর ঢলে প্লাবিত বসতঘর। ঘরের উঠানে থইথই পানির স্রোত। চাল-ডাল, কাঁথা-বালিশ আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন নৌকায়। গোয়ালঘরে বুকসমান পানি ওঠায় বসতবাড়ির খানিকটা দূরে উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে ১৩টি গরু আর ১০টি ছাগল বেঁধে রেখে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

গণি সরকার বলেন, ‘সাত দিন থ্যাকে জলত সংসার। লিজেরাই লৌকাত ভাসিচ্চি। গোয়ালঘরত বুকসমান পানি। গরু-ছাগল থুবার অ্যাকনা জায়গা নাই। খ্যাতে দুই বিঘা ঘাস আচলো, বানত শ্যাষ। খড় নাই, ভুসি নাই। লিজেরাই খাবার পাচ্চি না, গরু-ছাগলক খাবার দিমো কী?’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি মিচ্চি অ্যানা উঁচা জায়গা পাচনো, সেটি কোনোরকমে গরু-ছাগল বান্দে রাখিচ্চি। দিনত ভয় বানের ঢলের। রাতত চোর-ডাকাতের। গরু ছাগল লিয়ে কোন্টে যামো। চারডা গরু লৌকাত তুলে জুম্মারবাড়ি হাটল লিচনো। পানির দাম। গরু কিনবার লোক নাই।’

শুধু গণি সরকার নন, যমুনা নদীর ঢলে আগাম বন্যায় গোয়ালের গরু-ছাগল নিয়ে দিশেহারা হাজারো কৃষক-খামারি।

দলিকার চরের দিনমজুর আজিজার রহমান গত বছর কোরবানির ঈদে ধারদেনা করে তিনটা বাছুর কিনে লালন পালন করেছেন। সঙ্গে চারটা বাছুর আধিয়ার নিয়েছেন। আধিয়ারের ভাগের দুটিসহ পাঁচটা এঁড়ে গরু এবারের কোরবানির হাটে বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু কোরবানির বাজার এখনো জমেনি। এর মধ্যেই যমুনার ঢলে দুর্গম চরে আগাম বন্যা। বসতঘরে বুকসমান পানি। পাশে একটা উঁচু জায়গায় কোনোরকমে সাতটি গরু আর পাঁচটি ছাগল নিয়ে উঠেছেন। স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নৌকায়।

দিনমজুর আজিজারের স্ত্রী নুরুন নাহার বলেন, ‘যমুনার ঢলত গোটা চর ভাসিচ্চে। লিজেকেরেই অ্যাকনা মাথা গোঁজাবার ঠাঁই নাই। সাত দিন থিনি লৌকাত সংসার। ভাত ফুটাপার পারিচ্চি না। একবেলা খ্যায়া দিন যাচ্চে। গরু-ছাগলত খিলামো কী?’

দলিকার চরের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘মানুষেরই খাবার নেই, গরু-ছাগল-ঘোড়ার খাবার জোগাড় করি কেমনে? মানুষের চেয়েও এই চরে গরু-ছাগলের নিয়ে দুর্ভোগ বেশি।’

হাটবাড়ি চরের হাশিম আলী বলেন, ‘যমুনাত ঘেরা হামাকেরে বসতঘর। চারদিকত পানি। বর্ষাকালত কোন্টে অ্যাকনা আশ্রয় লেওয়ার জায়গা নাই। সারিয়াকান্দি ঘাটত যাতে লৌকাত সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সাঘাটা, জুম্মারবাড়ি যাবার গেলেও দুই ঘণ্টার পথ। ছলপল, ঘরের জিনিসপাতি লিয়ে সেটি ক্যাংকা করে যামো?’

চরের বাসিন্দা সুলতান আলী বলেন, ‘এ চরত ৪০০ পরিবারের বসবাস। অনেকের ঘরতই গরু-ছাগল আচে। কিন্তু খ্যাতের ফসল ডুবে গেচে। গরুর ঘাস লষ্ট হচে। এখন গরুর খাবার সংকট। গোয়ালঘরত পানি। গরু-ছাগল থোমো কোন্টে?’

গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দলিকার চরের সব মানুষ।
আউচারপাড়া চরের ফরহাদ হোসেন যমুনার ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তেকানিচুকাইনগর আশ্রয়ণকেন্দ্রে। সঙ্গে আটটি গরু। ফরহাদ বলেন, ‘বসতভিটা-আবাদি জমি সব যমুনার প্যাটত। লিজেকেরেই থাকার জায়গা নাই। সাত দিন থিনি খোলা আকাশের নিচত। আটটা গরু লিয়ে খুব সমস্যাত পরিচি। ঘাস নাই। খড় নাই। লেজেকেরে কষ্ট সহ্য হয়। গরুর কষ্ট সহ্য হয় না।’

সুজনেরপাড়া চরের কৃষক সাইফুল ইসলামের বসতভিটা যমুনায় ভেসে গেছে। ঠাঁই নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী গুচ্ছগ্রামে। তিনি বলেন, ‘গোয়ালত চারডা গরু আচলো। কোরবানিত ব্যাচপার চাচনু। কিন্তু কপাল খারাপ। তার আগেই ভাঙনে বিলীন বসতবাড়ি। নিজেরাই বানের পানিত ভাসিচ্চি। গরু রাকমো কোন্টে? গরু লিয়ে মরণ দশা। কী খাওয়ায়, কই থুই?’

সুজনেরপাড়া চরের গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি প্রায় ৩০০ পরিবার। সঙ্গে কয়েক শ গরু–ছাগল। আট দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে বানভাসি মানুষ। গবাদিপশু নিয়ে দিশেহারা তাঁরা। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা শিমুলতাইড় চরের ছইরন বেওয়া বলেন, ‘বসতভিটা, জায়গা–জমি সব শ্যাষ। লিজেরা না খ্যায়া আচি। তিনডা গরু লিয়্যা আরও মুশকিলে পরচি।’
সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, বন্যা ও নদীভাঙনে তাঁর ইউনিয়নে তিনটি চর বিলীন। আশ্রয়হারা সাড়ে তিন হাজার মানুষ। ঘরহারা মানুষের নিজেদেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। গোয়ালের গরু-ছাগল নিয়ে দিশেহারা তাঁরা।

বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় সারিয়াকান্দিসহ তিন উপজেলায় গো-খামারিদের প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলার ২৫৩ জন খামারির বিপুল পরিমাণ ঘাস নষ্ট হয়েছে। এ উপজেলায় আগাম বন্যায় ৩৫ হাজার গরু, ১০ হাজার ২০০ ছাগল, ১২০টি মহিষ ও ৪০০ ভেড়া পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গবাদিপশুর পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে কৃষকের গোয়ালঘর ও খামারের অবকাঠামোর। নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ গো–খাদ্য। তলিয়ে গেছে গো-চারণভূমি, আবাদি ঘাস।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, দুর্গত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে গো–খাদ্য বরাদ্দ চেয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল মিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য গো-খাদ্যের কোনো বরাদ্দ আসেনি। তিনি বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় গবাদিপশু নিয়ে খামারিদের সংকট সমাধানে উপজেলায় চারটি মুজিব কেল্লা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button