রাজনীতি

তারুণ্যের প্রতীক জাতির জনকের পুত্র শেখ জামাল

রনজিত কুমার পাল (বাবু):

তারুণ্যের প্রতীক জাতির জনকের পুত্র শেখ জামাল

১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ জামালের জন্ম হলেও তিনি বেড়ে ওঠেন ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। ইতিহাসের মহানায়ক আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ২য় পুত্র শেখ জামাল। শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুন নেছা দম্পতির পঞ্চম সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান শেখ জামাল একটা রাজনৈতিক বলয়ের ভেতর দিয়ে বড় হলেও অত্যন্ত ম্রিয়মাণ সুবোধ বালকের মতোই বাল্যজীবন অতিক্রম করেন।

শিক্ষাজীবনে শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, অতঃপর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। সদ্যস্বাধীন দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও শেখ জামালের সামান্যতম অহমিকাবোধ ছিল না। অন্য দশটি সাধারণ শিক্ষার্থীর মতোই তার জীবনাচার ছিল বিস্ময়কর। তবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৬/১৭ বছরের তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সাহসের নৈর্ব্যক্তিক আনুগত্যে দেশকে স্বাধীন করার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে। অগ্রজ শেখ কামালও মুক্তিযুদ্ধের মাঠে। পরিবারের বাকি সদস্য বিপন্ন জীবন অতিক্রম করছিল যুদ্ধকবলিত ঢাকা শহরে। পুরো ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়লাভ করলেও ক্লান্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল অনেক দিন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন এবং দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন।

নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় তিনি খুব দ্রুত দেশের চাকা ঘোরাতে সক্ষম হন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেবদূতে পরিণত হন। পরম পরাক্রমশালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কোনো সন্তানেরই সে অর্থে তেমন ক্ষমতা প্রদর্শন করেননি। শেখ রাসেল তো শিশু ছিল। কিন্তু অন্যরা পিতার অসীম ক্ষমতা বুঝতেন ঠিকই, তবে কখনো সে ক্ষমতার দাপটে প্রভাবিত হননি। এর মধ্যে শেখ জামাল ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এক তরুণ।

এই সুশীল বালককে পিতা শেখ মুজিব সৈনিক হওয়ার প্রেরণা দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভর্তির ব্যবস্হা করেন। একজন দক্ষ, যোগ্য ও চৌকশ সেনাকর্তা হিসেবে যাতে দেশসেবায় মনোযোগী হতে পারে সে দৃষ্টিভঙ্গিতে জামালকে প্রথমে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ২য় দফা ব্রিটেনের প্রিমিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে স্যান্ডহার্স্টে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে জবরদস্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি শেখ জামাল অত্যন্ত চমৎকার একজন গিটারবাদক ছিলেন। মিউজিক ইনস্টিটিউশন থেকে গিটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে খুবই স্বল্প সময়ে খ্যাতিমান গিটারবাদকে পরিণত হন।

সংস্কৃতির সাধক হয়ে ওঠা তরুণ শেখ জামাল একজন প্রথম সারির ক্রিকেটারও ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। এর মূল কারণ ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য। শেখ পরিবারের সব সদস্যই সংস্কৃতিমনা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় ভালো ফুটবলার ছিলেন। নানা ঘটনা-পরিক্রমায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাসস্হান হয়ে ওঠে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্হান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভক্ত। রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতই ছিল বঙ্গবন্ধুর বিনোদনের প্রধান উপাত্ত। আন্তঃসাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় ঘটতে পারে। কিন্তু সেটিকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে এবং তাকে একটি সৃজনমুখী আন্দোলনে পরিণত করতে চাই তারুণ্যের নেতৃত্ব।

শেখ জামাল সে নেতৃত্বই দিয়ে আসছিলেন তরুণ বয়সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তার সেই নেতৃত্ব ব্যাপকভাবে বিকশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারই সহকর্মী দ্বারা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাকেও হত্যার শিকার হতে হয়। উজ্জ্বল সম্ভবনাময় সামরিক কর্মকর্তার গতিপথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। সংস্কৃতির উত্কর্ষের জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়। বলা হয়ে থাকে, বিপথগামী কতিপয় সেনা কর্মকর্তা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এ আঘাত ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।

সুদূরপ্রসারী রোডম্যাপ করেই জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এর খেসারত বাঙালি জাতিকে দিতে হয়েছে দীর্ঘদিন। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যাওয়ায় বাঙালি জাতি সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি সময় একটানা ক্ষমতায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী দীর্ঘ সময় অর্থাত্ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত আমরা যেন সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা খাদে পড়েছিলাম। শেখ জামাল আজ আমাদের মধ্যে নেই; তার জন্মদিন নিয়ে লেখার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসের গতিপ্রবাহে এই মহান তরুণের কীর্তি চিরভাস্বর হয়ে আছে। তার কৃতিত্ব যদি জাতির সামনে তুলে ধরা না হয়, তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

শেখ জামালের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। যে ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের অহংকারের জায়গায় অধিষ্ঠিত। ফরিদপুর শহরে গড়ে উঠেছে শেখ জামাল স্টেডিয়াম। মাত্র ২১ বছর বয়সে শেখ জামাল ঘাতকের বুলেটে নিহত হলেও তিনি অমর হয়ে থাকবেন সবার হৃদয়ে, বিশেষ করে ক্রীড়াপ্রেমিক ও সংস্কৃতি লালনকারীদের অন্তরে। উল্লেখ্য, মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি এক সম্ভান্ত পরিবারের তরুণী রোজির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। একই সঙ্গে তার স্ত্রী শেখ রোজি জামালও ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পাননি। শেখ জামালসহ নিহত সবার প্রতি দেশের কোটি কোটি মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। শেখ জামাল তারুণ্যের অহংকার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button