বিনোদন

‘কোক স্টুডিও’ কি বাংলা গানের ক্ষতি করবে, নাকি বাড়াবে জনপ্রিয়তা ?

কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কোকা কোলার প্রযোজনায় আয়োজিত ফিউশন ভিত্তিক গান নিয়ে তৈরি টেলিভিশন সিরিজ ‘কোক স্টুডিও’ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’ নামে যাত্রা শুরু করার পর এই উদ্যোগের পক্ষে বিপক্ষে নানা রকমের সমালোচনা হচ্ছে। সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই উদ্যোগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে কোকা কোলা বাংলাদেশ।

কোক স্টুডিও সাধারণত বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের সংমিশ্রণ বা ফিউশনের মাধ্যমে গান তৈরি করে থাকে। স্টুডিওতে সঙ্গীতশিল্পী ও কলাকুশলীদের এক একটি লাইভ পারফর্মেন্সের মিউজিক ভিডিও দিয়ে তৈরি হয় টেলিভিশন সিরিজের এক একটি পর্ব।

বাংলাদেশে কোক স্টুডিওর প্রথম সিজনে মোট দশটি পর্ব থাকবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

ফিউশনের পক্ষে-বিপক্ষে যত বিতর্ক

অনেকেই এক ধরণের সঙ্গীতের সাথে আরেক ধরণের সঙ্গীতের মিশ্রণের ধারণাটি পুরোপুরি সমর্থন করেন না। তাদের অনেকে মনে করেন, সঙ্গীতে ফিউশনের ফলে লোকজ গান মৌলিকতা হারিয়ে ফেলে।

“ফিউশন বা মিক্স করার কারণে অনেক সময় গান মৌলিকতা হারায়, লোকজ গান আবেদন হারায় – যেটি সমর্থনযোগ্য নয় বলে আমি মনে করি”, বলছিলেন লোকজ গানের শিল্পী শাহনাজ বেলী।

মিজ বেলী মনে করেন, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে লোকজ গান পরিবেশন করলেও অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে লোকজ গানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে না।

পাশাপাশি লোকগানের সাথে প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করে ভিন্নভাবে পরিবেশন করার কারণে লোকগানের শিল্পীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন শাহনাজ বেলী।

“যারা সারাজীবন প্রকৃতির কাছে থেকে লোকগানের চর্চা করেছেন, তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু আজকাল দেখবেন অধিকাংশ অনুষ্ঠানে লোকগানের খুব চাহিদা। অনেক সময়ই এমন হয় যে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেসব লোক গান এমন লোকজন পরিবেশন করে – যারা হয়তো ইন্টারনেট দেখে গান শিখেছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, লোকগানের সাথে হয়তো যাদের সম্পর্ক খুব কম।”

এর ফলে অনেক সময় প্রকৃত শিল্পীরা আর্থিকভাবে এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বলেন মিজ বেলী।

আবার ফিউশনের পক্ষে সমর্থনও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকগান – যেগুলো তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না বলে হারিয়ে যেতে বসেছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন – ফিউশন করার কারণে মানুষের মধ্যে আবারো জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পেয়েছে।

ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি করা গানের একজন ভক্ত সাদিয়া আফরুন বলছিলেন, ফিউশন করার কারণে তিনি নিজে অনেক লোকগান শুনেছেন যেগুলো ফিউশন না করা হলে তার শোনা হত না।

“গান তো মানুষ যত শুনবে, তত বেশি প্রসার পাবে, ততদিন টিকে থাকবে। এখন আমার দোতরা, খোল, কর্তাল দিয়ে বাজানো গান ভালো লাগে না। কিন্তু ঐ একই গান যখন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে, নতুন রেকর্ডিংয়ে, সুন্দর করে পরিবেশন করা হয় – তখন সেটা আমার ভালো লাগে।”

“এটাকে অনেকটা এভাবে মনে করতে পারেন – যে আমাদের পুরনো গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল কারণ মানুষ সেগুলো শুনছিল না। সেগুলোকে বাঁচানোর জন্য তার সাথে নতুন অনুষঙ্গ যোগ করার পর মানুষের কাছে, তরুণদের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেল।”

“মনে করেন একটা বাচ্চাকে মিষ্টি মিশিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর মত একটা বিষয়। এতে করে আমাদের সঙ্গীত, সংস্কৃতিই লাভবান হয়েছে”, বলছিলেন মিজ আফরুন।

কোক স্টুডিও যেভাবে শুরু হয়েছিল

উপমহাদেশে এর আগে পাকিস্তান ও ভারতে কোকা কোলার আয়োজনে এই টেলিভিশন সিরিজ আয়োজিত হয়েছে।

পাকিস্তানে ২০০৮ সালে শুরু হয় এই টিভি সিরিজ – ঐ উদ্যোগের সহ আয়োজক ছিল পাকিস্তানের পপ ও রক ব্যান্ড স্ট্রিংস। আর ভারতে ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিজটির সহ আয়োজক ছিল এমটিভি।

তবে কোকা কোলার আয়োজনে এই ধরণের উদ্যোগ প্রথমে নেয়া হয়েছিল ব্রাজিলে, ২০০৭ সালে। ঐ উদ্যোগটির নাম দেয়া হয় ‘এস্তুদিও কোকা কোলা।’

ব্রাজিলের কোক স্টুডিওর আদলে পরের বছর পাকিস্তানে ‘কোক স্টুডিও’ তৈরি হয়।

২০১১ সালে ভারতে এমটিভি’র সাথে সহ প্রযোজনায় আয়োজন করা হয় কোক স্টুডিও, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘কোক স্টুডিও এমটিভি।’ এরপর ২০২১ সালে ফিলিপিন্সেও এই উদ্যোগ শুরু করে কোকা-কোলা।

অনুষ্ঠানের নাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা

ভারতে বা পাকিস্তানে কোক স্টুডিও নামটির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না থাকলেও ভারতেটরটি কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানেরটিকে কোক স্টুডিও পাকিস্তান বলে অনেকে সম্বোধন করেন।

কিন্তু বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক নামের সাথে বাংলা শব্দটি জুড়ে দেয়ায় অনেকে সমালোচনা করছেন।

অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রচলিত অন্যান্য ভাষার গান – বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরা যেসব ভাষা ব্যবহার করে – উপেক্ষিত হবে।

এরকম একটি আশঙ্কা প্রকাশ করে মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন উলফাত ফারিয়া সৈয়দ, যিনি তার স্ট্যাটাসে এরকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

“অনুষ্ঠানের নামে বাংলা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ঐ সন্দেহটা ওঠে, যে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার গান কী তাহলে এই অনুষ্ঠানে তৈরি করা হবে না? তাহলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের সংস্কৃতিকে অসম্মানিত করা হবে না?”

মিজ সৈয়দ বলছিলেন, “পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু তবুও কয়েকটা পর্ব প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি নিয়ে কিছুটা সংশয়ী থাকবো।”

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি মাথায় রেখেই অনুষ্ঠানের নামের সাথে ‘বাংলা’ শব্দটি সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানান অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কান্ট্রি হেড গাউসুল আলম শাওন।

তিনি বলছিলেন, “বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশের নাম ভাষার নাম থেকে উৎপত্তি। আমাদের দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই এটা রাজনৈতিক বা ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন।”

“তাই কোক স্টুডিও বাংলা বললে আমরা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে থাকা ১৭ কোটি মানুষ নয়, একবারে ৪০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি।”

নামের সাথে বাংলা সংযুক্ত থাকায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বাদ পড়ার আশঙ্কার অভিযোগ নিয়ে মি. শাওন বলেন, “আমরা প্রথম যেই গানটি রিলিজ করবো, সেটিতেই কিন্তু বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য বান্দরবান থেকে শিল্পী আনা হয়েছে। হাজংদের গান থাকবে প্রথম সিজনে। এটা যত সময় যাবে, তাদের অংশগ্রহণের হার তত বাড়বে। কাজেই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বাদ পড়ার ধারণা অমূলক।”

মি. শাওন জানান, এবারের সিজনের প্রথম পর্ব এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button