২০২১ সালে দেশের যেসব ইসলামী ব্যক্তিত্বকে হারালাম
মাওলানা আব্দুর রব মদিনা (রহ.) : তিনি ভারতের সাহারানপুরে শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা ছিলেন। রাজধানীর জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার প্রবীণ ওস্তাদ হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সবাই তাঁকে মদিনার হুজুর বলে চিনত। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে ইলমি অঙ্গনের এই মহাতারকার ইন্তেকাল হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
তাঁর হাতে গড়া বহু আলেম-উলামা দেশের আনাচকানাচে ইসলাম প্রচার করে যাচ্ছেন। বিশিষ্ট আলেম, বহু আলেমের আধ্যাত্মিক শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.) ছিলেন তাঁর ছাত্র। তিনি লালবাগ জামিয়ায় দীর্ঘদিন হাদিসের দরস দিয়েছেন। হাটহাজারী মাদরাসায় পড়াকালে তিনি আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)-এর সহপাঠী ছিলেন। তিনি ভারতের সাহারানপুরে শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর কাছে বুখারি ও আবু দাউদ পড়েছেন।
আল্লামা বেলায়েতুল্লাহ নূর (রহ.) : তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জামে মসজিদের খতিব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত আলেম প্রয়াত মুফতি নূরুল্লাহর চতুর্থ ছেলে। আল্লামা বেলায়েতুল্লাহ নূর জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী দেওবন্দ মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি গাজীপুর বরমী ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গুণী এই আলেম ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৮ বছর।
মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস (রহ.) : মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস (১৫ জানুয়ারি ১৯৫২-৩১ মার্চ ২০২১) বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি দেশের কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ বোর্ড আল-হাইআতুল উলিয়ার কো-চেয়ারম্যান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাবেক মহাসচিব ছিলেন। এ ছাড়া তিনি যশোরের মণিরামপুর আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য হন, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কীর্তিমান এই শীর্ষ আলেম ২০২১ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
মাওলানা হাফেজ কাসেম (রহ.) : তিনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের অন্যতম একজন। দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক সহকারী মুহতামিম ও ফটিকছড়ি তালিমুদ্দীন মাদরাসার মুহতামিম। মাওলানা হাফেজ কাসেম ছিলেন নাজিরহাট বড় মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা নূর আহমদ (রহ.)-এর ছেলে। তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় হলো, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান (রহ.)-এর জামাতা এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির কায়েদে মিল্লাত জুনাইদ বাবুনগরী (রহ.)-এর চাচা।
২০২১ সালের ৯ জুন চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে অবস্থিত তালিমুদ্দীন মাদরাসায় ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৭৫ বছর।
আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী : আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন বাংলাদেশের কওমি অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ইসলামী বক্তা ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির, দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদিস, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানি তালিমুল কোরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন।
তাঁর অনুসারীরা তাঁকে ‘মজলুম জননেতা’, ‘কায়েদে মিল্লাত’, ‘আপসহীন সিপাহসালার’ ইত্যাদি উপাধিতে ডেকে থাকে। তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)-এর শিষ্য ছিলেন। শেষ জীবনে মুসলিম নেতা হিসেবে তিনি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
২০২১ সালের ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালের পথে পাড়ি জমান। তাঁর ইন্তেকালে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (রহ.) : মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (রহ.) ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহামনীষী। আল্লাহভীরু ও উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হিসেবে তিনি সবার কাছে অত্যধিক গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বরং পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।
১৯৬৭ সালে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরি টাউন করাচিতে ভর্তি হন। সেখানে হাদিস ও ইফতা বিভাগের শিক্ষা সমাপ্তির পর তারা তাঁকে মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। একসময় মেধা-যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তিনি সেখানকার প্রধান মুফতি হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরি টাউন করাচির দ্বিতীয় মহাপরিচালক আল্লামা আহমদুর রহমান বলেন, ‘ফাতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী এক অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।’ (বাইয়্যিনাতে বান্নুরি, পৃষ্ঠা ২৪৪)
দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে ২০০১ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় প্রধান মুফতি হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর নিয়োগের পর হাটহাজারী মাদরাসায় দুই বছর মেয়াদি উচ্চতর হাদিসশাস্ত্র বিভাগ চালু হয়। শেষজীবনে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক পদও অর্জন করেন। ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা মনীষীর ইন্তেকাল হয়।
মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী : মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের মহাসচিব, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম মাদরাসার মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মজলিসে শুরার সদস্য, যুক্তরাজ্যের জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীনসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মসজিদ-মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৯৭৮ সালে ইসলামবিদ্বেষীদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামী আন্দোলন পরিষদ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় ছিদ্দিক আহমদের সাহচর্যে ছিলেন। কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলন ও খতমে নবুয়ত আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের তিনি মহাসচিব ছিলেন। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
২৯ নভেম্বর ২০২১ রোজ সোমবার ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।