কথার কথকতা
–মাইন উদ্দিন আহমেদ
লিখতেই পারছিনা! অসংখ্য বিষয় মাথার ভেতর কিলবিল করছে কিন্তু লেখার মত আকৃতি লাভ করছেনা। নিন্দুকেরা বলবে, “আরে মিয়া, কি লেখবা তুমি, পারলেতো, বেশি ভাব না দেখিয়ে থেমে যাও!” একথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়ে কি একটা লেখা লিখে ফেলা যাবে? আসলে সততা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে লিখতে পারা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বিষয়। উদোম করা বর্ণনা দিয়ে বেদম পেটানো যায় অনুচিত নির্মিতির পেছনের অংশে কিন্তু সত্য ও সুন্দরের চিত্রায়ন বা লিখন সত্যিই কঠিন, খুবই কঠিন। উপরন্তু সবাই যদি ফ্রী খেতে চায় তাহলে দোকানদারী চলে মাত্র কদিন! হ্যাঁ হ্যাঁ, লেখালেখির কথাই বলছি। কবিতা বলেন, গল্প বলেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বলেন আর ভ্রমণকাহিনী বলেন, যা-ই লিখবেন, কেনো লিখবেন? মন ও মননের তাগিদেইতো লিখবেন। শিক্ষা ও মেধার সমন্বয়েইতো লিখবেন। একবার মাত্রই কি লিখবেন? দ্বিতীয় লেখা পর্যন্ত আপনাকে বেঁচে থাকতে হবেতো! বেঁচে এবং থাকতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচতে হলে খেতে হবে, খাবার লাগবে, থাকতে হলে বাসা-বাড়ি লাগবে। এগুলো কে দেবে? ঢাকায় আপনি বই ছাপবেন, লেখা আপনার আর ছাপানোর টাকাও আপনার, নিউ ইয়র্কে লেখা ছাপবেন– কালি, কলম, কম্পিউটার, খাদ্য, বাসস্হান, লেখার হাত, মাথা, ভাবনা, বাক্য সব আপনার কিন্তু লেখাটা দিয়ে দেবেন ফ্রী! ঘটনা কি, এরকম কেনো, রহস্যটা কি? গোপনে শোনা যায়, “আরে মিয়া, করে খাও!” এরকম একটা সুর ঢাকা ও নিউ ইয়র্ক দুখানেই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে গুঞ্জরিত হয় যদিও বলা হয়, “নাথিং ইজ ফ্রী ইন নিউ ইয়র্ক।” এর রহস্য উন্মোচনে আমি মাথা খরচ করেছি অনেক। ভাবতে ভাবতে মগজের বাম পাশটা ব্যথা হয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যারাতে এ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে যখন দেখলাম যে, আর ভাবলে স্ট্রোক হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, তখন না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। খাবো কোত্থেকে, আমার জন্য কি জ্বীন-পরীরা খানা নিয়ে ব্যাটারীচালিত সাইকেলে এসে বাসার সামনে বসে আছে? আপনারা জানেন যে, এ অবস্থায় ঠিকমতো ঘুমও আসেনা। হালকা একটু তন্দ্রা আসতেই স্বপ্ন দেখলাম, কে যেনো আমাকে খুবই বকাবকি করছে! অবশেষে সামনে এসে এক বাউলের আকৃতি ধরে গানের সুরে প্রশ্ন করলো, “তোর পিতা আর মাতার জন্য কি করেছিস তুই, মান্দার গাছ রোপন করে পাবি ক্যামনে গোলাপ জুঁই?” তন্দ্রা টুটে গেলো, মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। উঠে নিজের মাথায় নিজে দুটো থাপ্পড় লাগালাম আর বললাম, “আম্মাগো, আব্বাগো, আমারে মাপ করে দিয়েন, এই অকর্মন্য পোলাডারে মাপ করে দিয়েন, আমি আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি, কিছুই করতে পারিনি। আমার মতো অযোগ্য কোন মানুষ বিধি যেনো পৃথিবীতে আর না পাঠায়, তথাকথিত ভদ্রলোক এখন পৃথিবীর প্রয়োজন হয়না।”
ঠিক এই সময় হঠাৎ যেনো একটা চিন্তার জট খুলে গেলো, লেখকদের সমস্যাটার একটা অসাধারন এবং অপার্থিব সমাধান খুঁজে পাওয়া গেলো। মনে হলো যেনো স্বপ্নেই একটা সমাধান নাজিল হয়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ ঘটনাটা বলছি, একটু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি, একটু ধৈর্য ধরুন, প্লীজ।
দুঃখিত, প্রিয় পাঠকমন্ডলী, ক্লান্তির কারনে হঠাৎই আবার ঘুম এসে গেলো। ঘুমানোর জন্য আগে আমার ট্যাবলেট খেতে হতো। ডাক্তার বললো, চেষ্টা করুন ঔষধ ছাড়া ঘুমাতে, শরীরের জন্য ভালো হবে। অবশ্য অতিক্লান্তি এবং অপর্যাপ্ত খাবারও আপনাকে একটি বাধ্যনিদ্রা উপহার দিতে পারে। এবারের ঘুমটা একটু গভীর হয়েই এসেছে। একটা স্বপ্ন আমার চেতনার দেয়ালে পর্দা ঝুলিয়ে চিত্রপ্রদর্শন শুরু করলো। একটা পত্রিকা অফিস পরিদর্শনে গেলাম। চমৎকার কাহিনী, চিত্রনাট্য, নির্মিতি এবং প্রদর্শনী!
পত্রিকার নাম দৈনিক স্বপ্নকথা। বিরাট এবং খুবই সুন্দর একটা অফিস, যেমন ভবন তেমনি ডেকোরেশন! রিসেপশানে অনেক মানুষ। ভাবসাব এবং যোগাযোগ প্রণালী অন্যরকম। দর্শনার্থীরা বসে আছেন। একজন চমৎকার গঠনের দামী পোশাক পরিহিত ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, সমবেত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্য করে বললেন, সম্মানিত ভিজিটরস, আমি স্বপ্নকথা পত্রিকার সম্পাদক, আপনারা জানেন আমাদের কর্মকান্ড অনেক বিশাল এবং প্রত্যহ আমাদের অফিসে অনেক মানুষ আসেন। আপনারা বসুন এবং আমাদের দেয়া চা-নাশতা খেতে থাকুন, এরি মধ্যে আপনার কাঙ্খিত ব্যক্তির সাক্ষাত পেয়ে যাবেন।
আমি গিয়েছি সাহিত্য সম্পাদকের সাথে দেখা করতে। চা-বিস্কুট পর্ব সারবার পর আমার ডাক এলো, ঢুকলাম, সাহিত্য সম্পাদক সাহেব বসতে বললেন, দাঁড়িয়ে সম্মান দেখালেন। বললেন, হাতে সময় আছেতো, বসুন, গল্প করবো, আপনাকে পেয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে। আমি বললাম, আমিও খুব খুশি, আপনার কথা অনেক শুনেছি, আপনার লেখা আমি পড়ি, ভালো লাগে। তিনি বললেন, থ্যাংক ইউ, বসুন। পিয়নকে বেল দিয়ে ডেকে কফি ও কেক দিতে বললেন।
সাহিত্য সম্পাদক সাহেবের রুম এবং টেবিল বেশ বড়, ওনার উল্টা দিকে আমি ছাড়াও আরো পাঁচজন লোক বসা।
সাহিত্য সম্পাদক সাহেব একপাশ থেকে শুরু করলেন। বলুন, আপনার কি খেদমত করতে পারি? দর্শনার্থী ভদ্রলোক বললেন, আমি একজন কবি, আমার নাম আবদুল কবির, আপনার পত্রিকার জন্য একটা কবিতা নিয়ে এসেছি। সাহিত্য সম্পাদক বললেন, খুব ভালো করেছেন, দিনতো কবিতাটি। অন্যরা দেয়না, আমরা লেখকদের প্রচুর সম্মানী দেই, আপনাকে কত দিতে হবে? কবি উত্তর দিলেন, “না, আমাকে সম্মানী দিতে হবেনা, আমারতো চাল-ডাল কিনতে হয়না, আমি কাব্যালঙ্কার সেবন করে ক্ষুধা নিবারন করি।” কবি তাঁর কবিতাখানি দিয়ে প্রস্হান করলেন।
পরবর্তী দর্শনার্থী বললেন, ওনার নাম জব্বর আলী গল্পতীর্থ। জব্বর আলী ওনার নাম আর গল্পতীর্থ ওনার উপাধি, এটি উনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন। কাগজে লেখা একটা গল্প তিনি সাহিত্য সম্পাদককে দিয়ে বললেন, এটা আপনার পত্রিকার জন্য। সম্মানী কতো দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “না লাগবেনা, আমার খাবার খরচ নেই, আগে পাবলিকের মতো সাধারন খাবার খেতাম, এখন গল্পের নির্যাস সেবন করি, সুতরাং সম্মানী লাগবেনা, ধন্যবাদ।”
এরপরের দর্শনার্থী বললেন, আমি উমর আলী গদ্যগুরু, আমার লেখালেখি আপনার পত্রিকা দিয়ে শুরু। আপনার জন্য একটা নতুন লেখা এনেছি। সম্মানী কতো দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “লাগবেনা কারন আমি সম্মানী এবং সাধারন পাবলিকের পরিমাপ থেকে অনেক উর্ধে উঠে গেছি, আমি সাধারন মানুষের মতো ভাত মাছ গোস ডাল এগুলো খাইনা, আমি তৎসম শব্দের রস সেবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, পয়সাকড়ি লাগবেনা।”
সাহিত্য সম্পাদক সাহেব বললেন, আমি আপনাকে চিনিতো উমর আলী সাহেব, ধন্যবাদ।
পরের চেয়ারে যিনি বসা তাঁর দিকে তাকালেন সাহিত্য সম্পাদক সাহেব, বললেন, কি খবর আবু আল রহমত সাহেব, অনেক দিন পর? তিনি উত্তর দিলেন, “ব্যস্ত থাকিতো তাই আসা হয়ে উঠেনা। আপনি জানেন, আমি ন্যাশনাল ইস্যুগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকি, ঐরকম একটা গবেষণামূলক নিবন্ধ এনেছি আপনার পত্রিকার জন্য।” সাহিত্য সম্পাদক সাহেব বললেন, “খুব ভালো করেছেন, দিন আমাকে লেখাটা, এটা ছেপে দেই আর আপনাকে একটা বড় এমাউন্টের বিল করে দেই।” আবু আল রহমত সাহেব বললেন, “না না বিল করতে হবেনা, আপনি জানেন আমাদের রাস্ট্রীয় গবেষণাগারে জাতীয় ঐতিহ্য এবং লেখকের অহংকার মিশ্রণে একটা সালসা আবিস্কৃত হয়েছে, জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে ওটা আমাকে ফ্রী দেয়া হয়, কোন সম্মানী দিতে হবেনা, ধন্যবাদ।”
সাহিত্য সম্পাদক সাহেব গদগদ কন্ঠে বললেন, “সত্যিই, জাতি আপনাদেরকে নিয়ে গর্বিত। আপনারা এভাবে অবদান রাখতে থাকলে এ জাতি একদিন সমগ্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই, আর আমাদের মিডিয়া জগত এক অসাধারন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতেই থাকবে। আমি আপনাদের জন্য সত্যিই প্রাউড ফিল করছি, আবার আসবেন।”
আমি উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, “ভাই দারুণ সময় কেটেছে এখানে, অসাধারন সময় কেটেছে, আবার আসবো আমাদের গর্ব ‘দৈনিক স্বপ্নকথা’ অফিসে! ভালো থাকবেন।”