সনাতনধর্মাবলম্বীদের মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের জীবনী কাহিনী
রনজিত কুমার পাল (বাবু) স্টাফ রিপোর্টারঃ
সনাতনধর্মাবলম্বীদের মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের জীবনী কাহিনী
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ, বেদান্তদর্শন, ভাগবত প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি।পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হলে, সত্যবতী গর্ভবতী হন। পরে যমুনা’র একটি দ্বীপে এঁর জন্ম হয়।
যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম হয় দ্বৈপায়ন। এঁর গায়ের রঙ কালো ছিল বলে, পুরো নাম দাঁড়ায় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। এঁর মাথায় কপিল বর্ণের জটা ছিল। তাঁর চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ছিল। ইনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ব্যাস নামে পরিচিত হন। জন্মের পরপরই ইনি তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন।
এঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম। এই কারণে ইনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন। মহাভারতের মতে– ইনি মহাভারত লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মার কাছে একজন লিপিকার নিয়োগের পরামর্শ গ্রহণ করতে গেলে- ব্রহ্মা গণেশকে নিয়োগ করতে বলেন। গণেশ এই শর্তে লিপিকার হতে সম্মত হলেন যে, লিপিবদ্ধ করার সময় ইনি ক্ষণমাত্রও থামবেন না। ব্যাস তাতে রাজী হয়ে অপর একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন যে, গণেশ কোন বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না বুঝে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না।
এরপর গণেশ এই শর্তে রাজী হলে– মহাভারত লিখা শুরু হয়।ব্যাসদেব তাঁর শ্লোক রচনার মাঝে মাঝে কিছু জটিল শ্লোক রচনা করেতন- গণেশ এই শ্লোকগুলির অর্থ বুঝে লিখতে যে সময় ব্যয় করতেন, সেই সময়ের মধ্যে ব্যাসদেব আরও অনেক শ্লোক বানিয়ে ফেলতেন। ব্যাসদেব একটি পুত্র লাভের আশায় সুমেরু পর্বতে মহাদেবের তপস্যা করতে থাকেন। শতবর্ষ আরাধনার পর মহাদেব তাঁকে পুত্রলাভের বর দেন। ব্যাসদেব পুত্র সন্তানের নাম রাখেন শূক।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ব্যাসদেবের বরেই সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ করেন। এই দৃষ্টির বলে তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের যথাযথ বিবরণ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কুরু-পাণ্ডব রমণীদের ইনি জাহ্নবী থেকে উত্থিত মৃত আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ করান। জ্ঞাতিবধের পাপস্খলনের জন্য ইনি যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধ-যজ্ঞ করতে উপদেশ দেন। গৌতমের রচিত ন্যায়শাস্ত্রের ত্রুটি ধরার কারণে, গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, চোখ দিয়ে ব্যাসদেবের মুখ দেখবেন না। পরে ব্যাস অনুনয়-বিনয় দ্বারা গৌতমকে প্রসন্ন করলে, তিনি ব্যাসদেবের মুখদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে,- এই বিবেচনায় গৌতম তাঁর পায়ে চোখ স্থাপন করে ব্যাসদেবের মুখ দেখেছিলেন। সেই থেকে গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ। ইনি বেদকে শতশাখাযুক্ত চার ভাগে বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে অভিহিত হয়েছেন।
ব্যাসদেব অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বেদান্তদর্শন রচনাও ব্যাসদেব অন্যতম কৃতিত্ব। বিষ্ণু অবতার ও কৃষ্ণ জীবনকথা নিয়ে রচিত ব্যাসদেবের এই অনবদ্য রচনায় মোট বারোটি স্কন্দ (সর্গ) ও প্রায় ১৮,০০০ শ্লোকে রয়েছে। হিন্দু সমাজে সুপরিচিত বহু উপকথার উৎসভাগবত পুরাণ।
তিনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং তার চার শিষ্যকে এক একটি বেদের সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন । এই কারণে ইনি বেদব্যাস নামে খ্যাত হন। তাঁর এই পরিকল্পনার ফলেই দেশের ও জাতির বিপর্যয় এবং বিধর্মীদের হাতে কোটি কোটি হিন্দু হত্যা, হাজার হাজার মন্দির ও শাস্ত্র ধংসের পরেও হিন্দু ধর্মের ও সমাজের ভিত্তি —বেদ হারিয়ে যায় নি। ভগবান ব্যাস পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও অষ্টাদশ উপপুরাণ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি। কলিযুগে সনাতন হিন্দু ধর্মের বর্তমান কাঠামো অনেকটাই ব্যাসদেবের নির্মিত ।
শৈব -শাক্ত- বৈষ্ণব -দ্বৈতবাদী -অদ্বৈতবাদী নির্বিশেষে সনাতন হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়-ই কোন না কোন সূত্রে ব্যাসের জ্ঞান , ভক্তি, তপস্যা , জীবকল্যানের আদর্শের সাথে যুক্ত আছেন। সেকারনে তিনি সনাতন হিন্দু সমাজের সার্বজনীন গুরু। (সংগৃহীত ও পরিমার্জিত)