করোনা মোকাবেলায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে পাঁচটি প্রস্তাবনা প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের জনপ্রিয় অর্থনৈতিক এই ফোরামে লেখা এক কলামে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, বরং পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে এই ‘কভিড১৯’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পারব আমরা।
প্রধানমন্ত্রী তার কলামে লেখেন, বিশ্ব এক অজানা এবং অদেখা শত্রুর বিরুদ্ধে আজ লড়াই করছে। এই শত্রুর কোন সীমানাবোধ নেই, নেই কোন শ্রেণী বোধ। সবচাইতে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে এই শত্রু।
করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী যেই পাঁচটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো ‘বৈষম্য দূর করতে নতুন করে ভাবতে হবে’। তিনি লেখেন, দারিদ্র ও বৈষম্য খুব দ্রুত বেড়ে যাবে আমাদের পরিচিত এই সমাজে। বিগত দশকে আমরা আমাদের অর্ধেক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। তাদের অনেকেই আবারো দরিদ্র অবস্থায় ফেরত যাবে। মানুষ ঋণের ফাঁদে পড়ে যাবে। আমাদের ৮৫ ভাগ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে চাকুরী করছে। আমাদের এসএমই (ঋণ ব্যবস্থা) বাজে ভাবে আঘাত করছে। এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ বা আফ্রিকার দেশগুলোতেও খুব একটা ভিন্ন নয়। আর সে কারণেই বিশ্বের সকলের এখন মানুষের ভালো কিভাবে করা যায় সে কথা ভাবা উচিত। কিভাবে বৈষম্যের মোকাবেলা করবে, দরিদ্রকে সহায়তা করবে এবং আমাদের অর্থনীতিকে কিভাবে প্রি-কভিড (কভিড১৯ সংক্রমণের আগের) পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে তা ভাবতে হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, ‘জি৭, জি২০ এবং ওইসিডি’র মত বলিষ্ঠ বিশ্ব নেতৃত্ব প্রয়োজন’। প্রধানমন্ত্রী এর ব্যাখ্যায় লেখেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাপনাকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক ক্লাউস সোয়াব এবং ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ‘ইনফেকশাস ডিজিজেস’-কে ‘গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২০’-এর কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করছি। বিশ্ব ব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থাকে এখানে গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয়েছে। আর সে কারণেই কভিড অ্যাকশন প্লাটফর্ম এবং রিজিওনাল অ্যাকশন গ্রুপের মতো ফোরাম গঠন এ সময়ে সঠিক পদক্ষেপ। আমি বিশ্বাস করি, এর পাশাপাশি বাড়তি উদ্যোগ হিসেবে জাতিসংঘের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কভিড-১৯ পরবর্তী পরিকল্পনা কি হবে তা ঠিক করে ফেলা উচিত।
‘নতুন ব্যবসার নিয়মগুলো নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে’-বলে তৃতীয় প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি লেখেন, আমরা এরই মধ্যে দেখেছি কিভাবে বিশ্বের ব্যবসা, কর্মক্ষেত্রে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। আর এই কভিড যুগের অবসান হলে ব্যবসার নতুন নিয়ম এবং চর্চা শুরু হবে। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি সাপ্লাই চেইনে থাকা অনেক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। আমি মনে করি পুঁজিবাদের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এর মাধ্যমে একটা পরীক্ষা চালাচ্ছে। আর আমাদের বাংলাদেশের মত দেশগুলোকে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে নতুন পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থ প্রস্তাবনায় তিনি লেখেন, ‘বৈশ্বিক দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে’। এখানে অভিবাসী শ্রমিকদের প্রসঙ্গ তুলে তিনি লেখেন, অভিবাসী শ্রমিকরা ধনী দেশগুলোর আয়ের পথে প্রথম সারিতে থেকে অবদান রাখছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই শ্রমিকদের জন্য কঠিন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি তারা চাকরীও হারাচ্ছে। এ কারণেও ঝুঁকির মুখে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি। আর সে কারণেই বৈশ্বিক দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ ছেড়ে পালিয়ে যাইনি। আপনারা হয়ত অবগত আছেন বিশ্বের সবচাইতে বড় শরণার্থী ক্যাম্প বর্তমানে আমাদের দেশে। আর আমাদের ‘কভিড১৯’ যুদ্ধের পরিকল্পনা এই ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে সঙ্গে নিয়েই করা হয়েছে।
সর্বশেষ প্রস্তাবনায় তিনি জানান, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (৪আইআর) ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হবে’। সেখানে তিনি বলেন, শেষ দশকে নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমাদের ‘এটুআই’ প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ডিজিটাইজেশনে চ্যাম্পিয়নে পরিণত হয়েছে। আর এই মহামারীর মধ্যেও আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং সংক্রমণ খুঁজে পেতে মোবাইল ট্রাকিংয়ের মত বেশ কিছু প্রযুক্তির সহায়ক টুলস ব্যবহার করেছি। আর ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবেও আমাদের প্রথমেই প্রয়োজন সমস্যাগুলোর উদ্ভাবনী সমাধান। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং সাপ্লাই চেইন খাতকে নিয়ে উদ্ভাবনী সব সমাধান প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। আর এমন এক পরিস্থিতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।
নিউজ ক্রেডিটঃ ইত্তেফাক অন লাইন