মিনিয়াপোলিস পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল নিয়ে টানা ৭ম দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। এই পর্যন্ত অন্তত পাঁচ জনের মৃত্যুও হয়েছে। দেশটির অন্তত ৪০টি শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এই হত্যার দৃশ্য নাড়া দিয়েছে পুরো বিশ্বের মানুষকে। তাই আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করে এবার রাস্তায় নেমেছে লন্ডন, বার্লিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরের সাধারণ জনতা।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সপ্তাহে আরও তিনটি বিক্ষোভের পরিকল্পনা রয়েছে লন্ডনে। এর মধ্যে একটি মার্কিন দূতাবাসের কাছে অনুষ্ঠিত হবে। সেন্ট্রাল লন্ডনে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী শ্লোগান দেয়, ‘নো জাস্টিজ নো পিচ’ (ন্যায়বিচার নাই, শান্তিও নাই)। বিপুল সংখ্যক জনতা শ্লোগান দিতে দিতে হাউজ অব পার্লামেন্টের দিকে যান, তারপর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে অবস্থান গ্রহণ করে বিক্ষোভ শেষ করেন। লন্ডনে মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বাইরে ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যে ৩ জনকে করোনাভাইরাস লকডাউন নির্দেশনা ভাঙ্গার কারণে আর ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে পুলিশের ওপর হামলার কারণে।
জার্মানির বার্লিনেও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে শতশত মানুষ। তারা শ্লোগান দেয়, জর্জ ফ্লয়েডের জন্য ন্যায়বিচার চাই, আমাদের হত্যা বন্ধ কর ইত্যাদি। বিক্ষোভ হয়েছে কানাডার টরন্টোতেও। সেখানেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে কয়েকশ মানুষ।
জর্জ ফ্লয়েডের খুনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ-অশান্তি পৌঁছে গিয়েছে হোয়াইট হাউসের দোরগোড়া পর্যন্ত। প্রতিদিন নতুন নতুন শহরে ছড়াচ্ছে বিক্ষোভের আগুন। দেশটির অন্তত ১৪০টি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবাদের আগুন। একাধিক শহরে বিক্ষোভ হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছে।
নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া এবং লস অ্যাঞ্জেলসের মতো শহরে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীদের একাংশ। কোথাও পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ডেট্রয়েট, ইন্ডিয়ানাপোলিসে। সেখানে গুলি চালানোর মতো ঘটনা ঘটেছে বলে জানাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্র। তারা জানাচ্ছে, অন্তত পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন, শিকাগো, মায়ামি, নিউ ইয়র্কের মতো দেশের অন্তত ৪০টি শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই পথে নেমেছেন মানুষ।
অনেকেই বলছেন, বর্ণবিদ্বেষের প্রতিবাদে এমন বড়সড় আন্দোলন ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যুর পর আর দেখেনি আমেরিকা। সারা দেশ জুড়ে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই বহু জায়গায় লকডাউন না মেনে পথে নেমেছেন মানুষ। তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধিও তোয়াক্কা করছেন না। করোনার প্রকোপে কিছু দিন আগেই বহু রাস্তা কার্যত জনমানবহীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনার পর সেখানে পথে নেমেছেন প্রতিবাদীরা। কৃষ্ণাঙ্গদের উপর পুলিশি জুলুমের অভিযোগ নিয়ে আমেরিকায় ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছিলই। ফ্লয়েডের মৃত্যু তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।
একাধিক জায়গায় এই সুযোগে লুঠপাটের ঘটনাও ঘটেছে। ফিলাডেলফিয়া, স্যান্টা মনিকা, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো কিছু জায়গায় লুঠপাটের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিকে অনেকে ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া ‘লন্ডন হিংসা’র সঙ্গে তুলনা টেনেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তত আটটি প্রদেশে নামানো হয়েছে পাঁচ হাজার ‘ন্যাশনাল গার্ড’। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে ঘটনাস্থল মিনিয়াপোলিসের প্রায় সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই প্রথম বার প্রদেশে ন্যাশনাল গার্ডের পুরো বাহিনীই এখন রাস্তায়। চার হাজার জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ, বিক্ষোভ ঠেকাতে দেদার লাঠিচার্জের পাশাপাশি রবার-প্লাস্টিক বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েছে পুলিশ।
মিনিয়াপোলিস প্রশাসনের দাবি, ঝামেলা পাকাচ্ছে বহিরাগতরাই। ট্রাম্প দায়ী করছেন অতি-বাম চরমপন্থীদের। ইতিমধ্যে অতি-বাম গোষ্ঠী ‘অ্যান্টিফা’-কে ‘জঙ্গি সংগঠন’ বলে ঘোষণা করেছেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, বর্ণবিদ্বেষের আগুন জ্বলছিলই, করোনায় বঞ্চনার ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বেকারত্বের জ্বালা বাড়তি ঘি ঢেলেছে আগুনে। সূত্র : ডেইলি মেইল, রয়টার্স।