ময়মনসিংহের দুই গ্রামে তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ বড়শির ছিপ
দেশে মাছ ধরার ক্ষেত্রে ফিশিং হুইল ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বড়শির ছিপের চাহিদাও ব্যাপক। আর বাঁশের তৈরি এ ছিপের অন্যতম জোগানদাতা ময়মনসিংহের দুটি গ্রাম।
জেলার মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের দুটি গ্রাম থেকেই অন্তত ১০ লাখ পিস ছিপ প্রতিবছর খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়ে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।
এর মধ্যে একটি গ্রামের ছিপ অনেক শৌখিন মাছ শিকারির কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা মনে করেন এই গ্রামের ছিপ দিয়ে মাছ ধরলে তাতে সাধারণত বেশি মাছ ধরা সম্ভব হয়। যদিও গ্রামটিতে ছিপ তৈরির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন এমন প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই।
বাঁশ দিয়ে তৈরি ছিপ তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠা গ্রাম দুটি হলো- ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন ইউনিয়নের বাদে মাঝিরা গ্রাম এবং জেলার গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রাম।
মানকোনার চেয়ারম্যান আমিনুল হক বলছেন, বাদে মাঝিরা গ্রামের বেশ কিছু পরিবার বংশ পরম্পরায় বড়শির ছিপ তৈরির সাথে জড়িত এবং এখানকার ছিপের চাহিদাও অনেক।
মূলত ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চল, কিশোরগঞ্জ থেকে শুরু করে সিলেট অঞ্চল জুড়ে হাওড় এলাকায় বর্ষার সময়ে বাঁশের বড়শির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় আর এ চাহিদার মূল জোগানদাতা হলো বাদে মাঝিরা ও লামাপাড়া গ্রাম।
কারা কীভাবে তৈরি করেন বড়শির ছিপ
বাদে মাঝিরা গ্রামে ছিপ তৈরি করে এমন পুরনো একটি পরিবারের নতুন প্রজন্মের মানুষ আমিনুল ইসলাম। ৩০ বছর বয়সী আমিনুল বিবিসিকে বলেন, পরিবার থেকেই এটিকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমার বাবাকে দেখেছি ছিপ বানানোর কাজ করতেন। আমিও করি। আমার কারখানায় অন্তত পনের জন কাজ করে।’
তিনি জানান, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার কয়েকটি এলাকা থেকে বিশেষ ধরনের বাঁশের কঞ্চি কিনে আনেন তারা। এর পর সেগুলোকে বড়শির আকারে কেটে ছোট ডালপালা সব ছেঁচে দেয়া হয়। পরে আগুনে তাপ দিয়ে বড়শির ছিপ প্রস্তুত করা হয়।
আমিনুল ইসলাম বলেন,‘সাধারণত বর্ষার সময়ে মাছ ধরা বেড়ে যায় এবং এ সময়েই ছিপ বেশি বিক্রি করি আর বাকি সময়ে ছিপ এভাবেই তৈরি করে রাখি। চলতি বছর আমার কারখানাতেই দুই থেকে আড়াই হাজার পিস ছিপ তৈরি হচ্ছে।’
মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ নামে আরেকজন ছিপ তৈরির কারিগর বলেন, ‘সিজনে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করি আমি। বিশেষ করে বর্ষার সিজনে প্রচুর বিক্রি হয়।’
তিনি বলেন, দীর্ঘকাল ধরেই তাদের এলাকায় তৈরি ছিপের প্রশংসা আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে এসে ছিপ নেয়। আবার পাইকাররাও এসে নিয়ে যায়। এর বাইরে ছিপ বাজারজাত করে এমন অনেক বড় ব্যবসায়ীরাও আসেন এখানে।
কেনে কারা, দাম কেমন
মোহাম্মদ আামিনুল ইসলাম ও আব্দুল মজিদ বলছেন আকারের ভিত্তিতে তিন ধরনের ছিপ তৈরি হয় তাদের এলাকায়। এর মধ্যে বড়টি ৪০, মাঝারিটা ২৫ ও ছোটটি ২০ টাকা ধরে বিক্রি করেন তারা। আর ক্রেতাদের বড় অংশই আসেন উত্তরবঙ্গের নানা জায়গা থেকে।
আব্দুল মজিদ বলেন, ‘মূলত পুরো উত্তরবঙ্গের ছিপ বিক্রি করেন এমন ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ছিপ সংগ্রহ করেন।’
অন্যদিকে লামাপাড়ায় যে ছিপ সেটি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি শৌখিন মাছ শিকারিদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। বগুড়া থেকে সম্প্রতি লামাপাড়ায় গিয়ে এক ডজন ছিপ নিয়ে এসেছেন শহীদুল ইসলাম নামে এক তরুণ, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা তার শখ।
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমি নিজেই গিয়ে লামাপাড়া থেকে বড়শির ছিপ কিনে এনে বড়শি বানাই। ছিপগুলো ভালো লাগে আর টেকসই হয়।’
তিনি জানান, এবার তারা হাওড় এলাকায় দল বেঁধে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন এবং সেজন্য পুরো দলের সবার জন্য ছিপ আনানো হয়েছে মুক্তাগাছা ও গৌরীপুর থেকে।
স্থানীয় সাংবাদিক শফিক সরকার বলছেন, মুক্তাগাছার বাদে মাঝিরা গ্রামে অনেক পরিবারই ছিপ তৈরির কাজে নিয়োজিত যেখানে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।