দেশে গত সাড়ে ৩ মাসে করোনায় সর্বোচ্চ প্রানহানি
গত এক মাসে কয়েকবার দেশে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তে নতুন রেকর্ড হয়েছে। কিছুদিন আগে সাপ্তাহিক মৃত্যুর বিচারে শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় ওঠে আসে বাংলাদেশের নাম। মঙ্গলবারও সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার হিসেবে সর্বোচ্চ ২৫৮ মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে দেশে মোট প্রাণহানি ১৯ হাজার ৭৭৯ অর্থাৎ ২০ হাজার ছুঁইছুঁই।
পেছনে ফিরলে দেখা যায়, দেশে করোনা মৃত্যু ১০ হাজার ছাড়াতে এক বছরের বেশি সময় লাগলেও পরবর্তী ১০ হাজারের ঘরে পৌঁছাতে সাড়ে তিন মাসেরও কম সময় লাগছে।
২০২০ সালে ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। সে দিন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ব্যক্তি পুরুষ। তার বয়স ৭০ বছর।
মারা যাওয়া ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসা ও সংক্রমিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানান আইইডিসিআর পরিচালক। তখন পর্যন্ত দেশে মোট ১৪ জন করোনায় আক্রান্ত হন।
ওই দিন মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, করোনাভাইরাসের ফলে হওয়া কভিড-১৯ রোগটি মারাত্মক নয়। কিন্তু ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে মৃত্যুঝুঁকি থাকে না। এ ক্ষেত্রে সচেতন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর ১৩ মাস পর চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন অনুসরণ করে জানা যায়, কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে সে দিন।
ওই দিনের ৯৪ জন-সহ মোট প্রাণহানি হয় ১০ হাজার ৮১ জন মানুষ। একই দিন ৪ হাজার ১৯২ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হন। মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২১ শতাংশে পৌঁছে।
এর সাড়ে ৩ মাস পর ২৭ জুলাই রেকর্ড ২৫৮ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭৭৯ জন। ৫২ হাজার ৪৭৮ নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয় ১৪ হাজার ৯২৫ রোগী। শনাক্তের হার ২৮.৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ, শনাক্তের হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫২ জন।
পরিসংখ্যান আরও বলছে, মৃত্যুর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, গত ২৭ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা গত ১৬ মাসের যে-কোনো মাসকে ছাড়িয়ে গেছে। এ মাসের এখনো তিন দিন বাকি। অথচ এরই মধ্যে দেশে মোট মৃত্যুর ২৭ শতাংশই এ মাসে হয়েছে। এই হার মোট মৃত্যুর চার ভাগের এক ভাগ।
এমনকি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন রোগীদের জটিলতা অনেকগুণ বেড়েছে। মৃত্যুর ধরনও বদলেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আগে সাধারণত আক্রান্তের দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগীদের মারা যেতে দেখা গেছে। এখন আক্রান্তের দুই-তিন দিনের মধ্যেও রোগীরা মারা যাচ্ছেন। পাশাপাশি এত দিন বয়স্কদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন সে ব্যবধান কমে আসছে। তরুণদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
এমনকি সামনের দিনগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করেছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোরবানির ঈদে শিথিলতার কারণে এই সপ্তাহের পর থেকে শনাক্তের সংখ্যা ও তার পরের সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। চলমান বিধিনিষেধের কারণে তারপর কমতে থাকবে।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, এখন মৃত্যুর ধরন বদলেছে। আগে আমরা বলতাম আক্রান্তের দুই-তিন সপ্তাহ পর মৃত্যুর প্রভাব বোঝা যায়। কিন্তু এখন যেসব রোগী দুই-তিন দিন আগে হাসপাতালে আসছে, তারাও মারা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ দেরিতে হাসপাতালে আসা। এখনো অনেকে মনে করে যে, করোনা হয়নি, প্রতিবছরের মতো এখনকার সর্দি কাশিও সাধারণ। মানুষের এই ধারণা খুবই ক্ষতিকর।
মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে আসতে পারছেন না বা আসেন না। শ্বাসকষ্ট শুরু না হলে টেস্ট করান না, হাসপাতালেও আসেন না। যখন আসেন, তখন অবস্থা খুব জটিল হয়ে যায়, কিছু করার থাকে না।
এ দিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ দেশে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ পালন করা হয়। এ সময় সব ধরনের অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়। ২১ জুলাই ঈদুল আজহা উপলক্ষে এই বিধিনিষেধ আট দিনের জন্য শিথিল থাকার পর গত শুক্রবার থেকে আবার দুই সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে টিকাকরণ চলছে। ইতিমধ্যে ১ কোটি ২৩ লাখের বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে।