জেলার খবর

ধামরাই ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দিরে রাস উৎসব উদযাপিত।

রনজিত কুমার পাল (বাবু) স্টাফ রিপোর্টারঃ

ধামরাই ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দিরে রাস উৎসব উদযাপিত।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঢাকার ধামরাইয়ের ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির পরিচালনা কমিটির আয়োজনে রাস উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। তবে বৈশ্বিক মহামারী নোভেল করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব এর কারণে সরকারের স্বাস্থ্য বিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত ভক্তবৃন্দের উপস্থিতিতে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকায় রীতি নীতি আচার অনুষ্ঠান মেনে উদযাপন করা হয়।

রবিবার (২৯শে নভেম্বর) রাতে ধামরাই কায়েতপাড়াস্হ শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির প্রাঙ্গনে শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির এর পুরহিত শ্রী উত্তম কুমার গাঙ্গুলি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় ধর্মীয় রীতি নীতি আচার মেনে রাস উৎসব অনুষ্ঠানের ক্রিয়াদি পালন করে রাস উৎসব উদযাপন করা হয়।

এ’সময় মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সীমিত সংখ্যক কর্মকর্তা ও ভক্তবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
রাস উৎসব এর ঐতিহাসিক তত্ত্ব -কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাঁদের প্রাণের মিলন উৎসব রাস উদযাপিত হয়।

বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাস। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন।

বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাধা শক্তি অর্থাৎ হ্লাদিনীশক্তির প্রকাশ সেটিই হল রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। বিজ্ঞানে যাকে বলা হচ্ছে অরবিট সার্কেল।

পুরুষ হল ধনাত্মক শক্তি আর প্রকৃতি হল ঋণাত্মক শক্তির আধার। এই দুয়ের মিলন সঞ্চারের রচনাশৈলীই হল রাসবিজ্ঞানের গূঢ়তত্ত্ব। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এক অসামান্য আনন্দ উৎসব।

পদ্মপুরাণে (৫২/১০৩-১০৫) শারদ রাস ও বাসন্তী রাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) বাসন্তী রাস এবং শ্ৰীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে (৫/১৩/১৪-৬১) শুধুমাত্র শারদ রাসের বর্ণনা আছে। হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাঁকে “রাস” নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপ রমণীদের সঙ্গে। শ্ৰীধর স্বামী বলেছেন, বহু নৰ্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষের নাম রাস– “রাসো নাম বহু নৰ্ত্তকীযুক্তেনৃত্যবিশেষঃ।”

শ্ৰীমদ্ভাগবতের অন্যতম টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, —“নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাস ক্রীড়া”। শ্ৰীমদ্ভাগবতের মতে, শ্রীকৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন-“যখন করেন হরি বস্ত্ৰহরণ।
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।

আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে। করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।”

শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ আপনাপন কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাঁদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন।

ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাঁদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাঁকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না।

তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাঁদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন শুরু হয়েছিল।
শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখীর নাম গুলো হচ্ছে ১)ললিতা ২)বিশাখা ৩)চিত্রা ৪)ইন্দুরেখা ৫)চম্পকলতা ৬)রঙ্গদেবী ৭)তুঙ্গবিদ্যা ৮)সুদেবী এছাড়াও বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’।

পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের উদযাপন— সংক্ষেপে এটাই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা।

পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন। নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে থেকে, এর উত্তরে স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল।

তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে। এখন শক্তিতন্ত্রই হোক আর বৈষ্ণব তন্ত্রই হোক রাস আদতে একটি মনস্তাত্ত্বিক মিলনের প্রক্রিয়াকরণের অনুষ্ঠান। যা সত্য-ত্রেতা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button