ধর্ম ও জীবন

সম্পদ নয়,জ্ঞানই উত্তম, প্রশ্নের দশটি জবাব

আবদুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রতিনিধি-(যশোর)

সম্পদ নয়,জ্ঞানই উত্তম, প্রশ্নের দশটি জবাব

মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা,)।হযরত সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি স্পষ্টভাষী ও উচ্চাঙ্গের ভাষা সাহিত্যিক। একজন সুবক্তা হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল সর্বত্র।জ্ঞান প্রজ্ঞা, বীরত্ব-বাহাদুরী ও বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেন, আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা।

তাঁর খ্যাতি ছিল দেশ-বিদেশে । সে একবার তার কথা শুনত সেই মুগ্ধ হয়ে যেত।ভাবত ,এত বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার কিভাবে তিনি অর্জন করলেন?এত জ্ঞানের কথা কে শেখাল তাকে?

কিন্তু সব মানুষ তো আর সমান নয়।যাদের হৃদয়টা হিংসার কালিমায় আচ্ছাদিত,যারা অপরের ভালো দেখতে পারেনা ,তারা আলী রা, এর এই সুনাম সহ্য করতে পারত না। তারা কৌতুক করে বলত,আলী আবার পন্ডিত হল কবে থেকে? সে তো গোটা জীবন মুহাম্মাদের পিছে ঘুরে বেড়িয়েছে । মাঠে ময়দানে যুদ্ধ করে করেছে ।বড় জোর সে একজন যোদ্ধা হতে পারে। কিন্তু পন্ডিত হবে কি করে?

একদিন কয়েকজন হিংসুটে একত্রিত হলে। পরামর্শ করল তারা । সিদ্ধান্ত নিল, আলীর পন্ডিত্যের পরিক্ষা আজই নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? আলোচনার মধ্যে তাও ঠিক হলো-

তারা সবাই একত্রিত হয়ে আলী রা,এর দরবারে উপস্থিত হবে। নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী তাকে প্রশ্ন করবে। যদি তিনি প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেন তবে তো ভালোই।আর যদি না পারেন, তাহলে বুঝা যাবে , তার জ্ঞানী হবার কথা সঠিক নয়। মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও গুজব মাত্র।

যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। শীর্ষস্থানীয় দশ পন্ডিত হযরত আলী (রা,) এর দরবারে উপস্থিত। দলনেতা সকলের সামনে। বাকিরা পিছনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে।কক্ষে বিরাজ করছে এক অসীম নিরবতা।

এক সময় দলনেতাই নিরবতা ভাঙ্গল । বলল,
: আমীরুল মুমেনীন। শুনেছি, আপনি একজন মহাপন্ডিত । অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তাই বহুপথ অতিক্রম করে অনেক কষ্ট স্বীকার করে আমরা আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। আশাকরি আপনার প্রজ্ঞাপুর্ণ বক্তব্যে আমাদের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবৃত্ত হবে।

: আমি মহাপন্ডিত নই। তবে আপনাদের বক্তব্য খুলে বলুন। শান্ত কন্ঠে হযরত আলী (রা,) বললেন।
: অনুমতি পেলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
: এ সামান্য ব্যাপারে অনুমতি কি প্রয়োজন। বলুন,কি প্রশ্ন আপনাদের।

: আমাদের প্রশ্ন হল, সম্পদ এবং জ্ঞান এ দুটির মধ্যে কোনটি উত্তম এবং কেন?

ও সে কথা শুনুন তাহলে “””””””।
হযরত আলী (রা,) কথা শেষ করতে পারলেন না। দলনেতা বাধা দিয়ে বলল, জনাব এ প্রশ্নের কেবল একটি জবাব দিলে চলবে না । আমরা মানুষ দশজন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক জবাব দিয়ে জবাবের সংখ্যা আবশ্যই দশে পৌঁছাতে হবে।

দলনেতার কথা শুনে হযরত আলী (রা,) কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। ভাবলেন, একটি প্রশ্নের দশটি জবাব দিতে হবে কেন? তবে কি তাঁরা বিশেষ কোন উদ্দেশ্য বা দুরভিসন্ধি নিয়ে এখানে এসেছে? নাকি আমাকে পরিক্ষা করতে এসেছে? সে যাই হোক, প্রশ্ন যেহুতু করেছে সেহেতু তার জবাব দেয়া উত্তম। তিনি বললেন আমি দশজনের দশটি জবাবই দিচ্ছি । আপনারা মনোযোগের সাথে শুনুন।

উপস্থিত সকলেই এক দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে আছে হযরত আলী (রা,) এর মুখপানে। জবার শোনার জন্য সকলেই উদগ্রীব। কারো মুখে কোন কথা নেই । গোটা কক্ষ তখন নিরব।

খানিক পর। হযরত আলী রা, একটু নড়েচড়ে বসলেন। শুরু হলো তার জবাবের পালা। সকলের বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি তাঁরই প্রতি নিবদ্ধ। তিনি বললেন –
অনেক কারনেই জ্ঞান ধনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ । তবে আপনারা দশ জনের জন্য দশটি কারণই বলছি।

১। জগতের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হল নবী রাসুলগণ। আর মহাপুরুষ ও মহামনীষীদের বিবেচনায় যা শ্রেষ্ঠ তা বাস্তবিকই শ্রেষ্ঠ হতে বাধ্য। নবী রাসুগণ জ্ঞান অর্জনের জোর দিয়েছেন, সম্পদ অর্জনের উপর নয়। পক্ষান্তরে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে সর্বাধিক উৎসাহিত করেছে ফেরাউন ও নমরুদের ন্যায় অভিশপ্ত লোকেরা । তারাই সম্পদের জয়গান গেয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত । সে কারণেই সম্পদ অপেক্ষা বিদ্যা শ্রেষ্ঠ ।

২। সম্পদ পাহারা দিয়ে রাখতে হয় । কিন্তু জ্ঞান পাহারা দিয়ে রাখতে হয় না। এমনকি আল্লাহ চাহেতো উহা মানুষ কে নানাবিধ বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ ‌।

৩। সম্পদ মানুষের মাঝে হিংসার জন্ম দেয় । শত্রুতা সৃষ্টি করে । পক্ষান্তরে জ্ঞান মানুষের মাঝে তৈরি করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন । পরিণত করে পরস্পরকে অকৃত্রিম বন্ধুত্বে । সুতরাং সম্পদ নয়, জ্ঞানই উত্তম ।

৪। জ্ঞান বিতরণে তা কখনো হ্রাস পায় না । বরং যতই বন্টন করা যায় ততই তা বৃদ্ধি পায়, প্রসারিত হয় । কিন্তু সম্পদ এর ঠিক উল্টো । অতএব সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই উত্তম ।

৫। জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের কোন কৃপণতা থাকেনা । জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মন থাকে আকাশের মত উদার । কিন্তু সম্পদ মানুষ কে কৃপণ হিসেবে গড়ে তোলে । সম্পদের প্রতি এক দুর্লভ মোহ সর্বদাই তাদের অন্তরে বিরাজ করে । সুতরাং সম্পদ অপেক্ষা জ্ঞান উত্তম ।

৬। সম্পদ চুরি হয় ,ডাকাতি হয় । কিন্তু জ্ঞান চুরি করা অসম্ভব । জোর করে কেউ তা কেড়েও নিতে পারে না। উহা লুন্ঠিত হওয়ার কোন ভয় নেই । সকলের জন্য উহা নিরাপদ সম্পদ । তাই ধন সম্পদের তুলনায় জ্ঞানই উত্তম।

৭। জ্ঞানের ক্ষয় নেই লয় নেই। কোনদিন ধ্বংস হওয়ার ভয় নেই । একবার অর্জন করলে কোন দিন তা আর নষ্ট হয় না । কিন্তু সম্পদ ক্ষণস্থায়ী । আজ আছে কাল নাই । তাই সম্পদের তুলনায় জ্ঞান শ্রেষ্ঠ ।

৮। জ্ঞান আসীন ,অনন্ত । এর কোন সীমা পরিসীমা নেই । কোন কিছু দিয়ে একে পরিমাপ করা যায় না । কিন্তু সম্পদ এর সম্পুর্ন বিপরীত । সহজেই এর আকার আয়তন ঠিক করা যায় । পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় । তাই সম্পদ অপেক্ষা জ্ঞান উত্তম ।

৯ । জ্ঞান মানবাত্মাকে উজ্জ্বল করে । আলোকিত করে । কিন্তু সম্পদ অন্তরকে কলুষিত করে । সুতরাং সম্পদ নয় জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ ।

১০। জ্ঞানের তুলনায় সম্পদ কোন মুল্যই রাখে না ।কারণ জ্ঞানই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল সততা ,সত্যবাদিতা ,খোদাভীরুতা , ও মানবতার ন্যায় মহৎগুণগুলো । তিনি গড়ে উঠেছিলেন মানব দরদী হিসেবে । পক্ষান্তরে বিপুল সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্যের অধিকারী হয়েও ফেরাউন নমরুদ ও কারুণ মানব দরদী হতে পারেনি ‌। পারেনি সবর -শোকর ,দয়া পরোপকার ও বিশ্বস্ততার ন্যায় মানবীয় গুণাবলী অর্জন করতে । বরং তারা হয়েছে কৃপণ , অহংকারী ও ধনলিন্সু ।

এতক্ষণ সকলেই হযরত আলী রা, এর প্রজ্ঞাপুর্ণ জবাব গ্রোগ্রাসে গিলছিল । তন্ময় হয়ে শুনছিল তার কথা । এক প্রশ্নের দশটি জবাব শুনে সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হল । বুঝল , হযরত আলী রা, সত্যিকার অর্থে একজন পন্ডিত , জ্ঞানের সাধক । তার জ্ঞানের কোন তুলনা নেই ।

আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে সম্পদের উপর জ্ঞান কে প্রধান্য দেয়ার তৌফিক দান নসীব করুন । পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহ পাক বলেন , তোমরা কি আখেরাত বাদ দিয়ে দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছ? ( মনে রেখ ) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নেহায়েতই তুচ্ছ । ( সুরা তাওবা : ৩৮ )

লেখক মোঃ আবদুল্লাহ আল মামুন , সাংবাদিক লেখক ও সাবেক শিক্ষক
যশোর জেলা প্রতিনিধি-নিউজ জাতীয় বাংলাদেশ ডটকম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button