বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী মানবতাবাদী জননী।
ছেলের তখন অনেক নাম হয়েছে। বই লিখে বই বিক্রি করে রোজগার ও অনেক। বাবার ইচ্ছে, বাড়িতে খুব আলো জ্বালিয়ে বাজনা বাজিয়ে ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। মা বাবার মত লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু মার ইচ্ছেও কি তাই? না, মার ইচ্ছে কিন্তু অন্যরকম। মা চান, পুজোতে ধুমধাম থাক বরং গরিব-দুঃখীদের খাওয়ানো হোক। ছেলে বিদ্যাসাগর বললেন, ঠিক আছে দুইই হবে। ধুমধাম বাজনা- টাজনাও হবে, কিন্তু পাঁচটা গ্রামের গরিব-দুঃখীদের খাওয়ানোটাও বাদ যাবেনা। মা ছেলেকে এমনও বলেছিলেন আর একবার, বছরে একবার অনেক টাকা খরচ করে পুজো করে কি হবে? তার চেয়ে সেই টাকায় গ্রামের গরিবদের রোজ খাওয়ার ব্যবস্থা করো। টাকা সার্থক হবে।
মায়ের হাতে গয়না বলতে ছিল এক রুপোর বালা। এই নিয়ে একজন ঠাট্টা করলেন, এমন যার ছেলে তার মায়ের হাতে শুধু রুপোর বালা?
মা ভগবতী দেবী বললেন, বাছা, এই হাতে রান্না করে হাজার হাজার লোককে অন্ন দিয়েছি উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের সময়। তাতেই আমার হাত গয়নায় ভরে গেছে। তুমি সে গয়না দেখতে পাচ্ছ না বুঝি?
এই গয়না পরা নিয়ে আর একটা গল্প আছে। গরিব ঘরে সংসার চালাতে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে যাকে, গয়না কি করে হবে? তাই ছেলে যখন ভাল রোজগার করছে ওই বিদ্যাসাগর ছেলের শখ হয়েছে মার জন্য গয়না বানাতে। মা বললেন, একটাই কিন্তু হবেনা, তিন তিনখানা গয়না চাই আমার। ছেলে তাতেই রাজি। মা গয়না চাইছে এতেই তার আনন্দ ধরে না। কী কী গয়না চাই একবার বলো। মা বললেন,- কি বললেন শুনে অনেকেই আকাশ থেকে পড়বেন। প্রথম গয়না- গ্রামের ছেলেদের জন্য একটা বিনা মাইনের ইস্কুল করে দিতে হবে। দ্বিতীয় গয়না -গ্রামের গরিবদের জন্য একটা ডাক্তারখানা করে দিতে হবে, যেখানে তারা বিনে পয়সায় চিকিৎসা করাতে পারবে, বিনে পয়সায় ওষুধ পাবে। আর তৃতীয় গয়না- আমার গ্রামের দুস্থ ছেলেদের থাকা-খাওয়ার একটা বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। বুঝুন একবার -এই সবের নাম গয়না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মায়ের হিসেব ঐরকম। তা ওই তিনখানা গয়নাই করে দিয়েছিল ছেলে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরের মা সংসারের কাজ শেষ করে রাত দেড়টা- দুটোর সময় দু ঘন্টা ধরে চরকা কাটতেন।
সকলেই বলে, কি দরকার মা? ছেলেরা সবাই প্রচুর রোজগার করছে। এখন খামোখা পরিশ্রম করো কেন? কি হবে ও দু পয়সার সুতো কেটে? শরীরটাও তো ভেঙে যাবে এত খাটলে। ভগবতী দেবী কারও কথা শোনেন না।
শেষে একদিন সেজো ছেলে শম্ভুচন্দ্র রাগ করে ভেঙে দিলেন সেই চরকা।
গভীর দুঃখে মা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলেন। মুখে জলও তুললেন না। বিপদ গনলেন শম্ভুচন্দ্র। নতুন চরকা বানিয়ে দিয়ে তবে মায়ের অভিমান ভাঙলেন।
যখন আমাদের দেশের মেয়েরা স্বাধীনতা বলতে কিছু বুঝতেন না– বা তাঁদের বুঝতে দেওয়া হত না, সেই সময়ে ওই চরকাটা ছিল ভগবতী দেবীর নিজের স্বাধীন জিনিস, নিজের রোজগারের উপায়। ছেলেরা তাঁর দুহাত ভরে টাকা-পয়সা দিয়ে দিত। গ্রামের হাঁড়ি- ডোম- মুচি ঘরের ঘুরে বেড়াতেন তিনি, সাগু মিছরি কোচড়ে বেঁধে। তাদের রোগ বালাই দেখলে ঔষধ দিতেন। পথ্যের ব্যবস্থা করতেন। তাতেই হয়ত লাগত সুতো কাটার রোজগার। সব সময় ছেলেদের কাছে হাত পাতবেন, এমন মা তো ভগবতী নন।
বাড়ির সকলের দুপুরে খাওয়া শেষ, কিন্তু মা তখনও মুখে অন্ন তুলবেন না। যদি হঠাৎ কোনো অতিথি এসে দুমুঠো ভাত চায়! যদি এমন কোন ভিখারি এসে পড়ে যার তখনো খাবার জোটেনি।
হাটের দিনে ভগবতী দাঁড়িয়ে থাকেন সদর দরজায়। কেউ শুকনো মুখে হাট থেকে ফিরছে, ডেকে বলেন– আহা রে বাছা, কিছু খাস নি বুঝি এখনো? আয়, বাড়িতে এসে দুটো ভাত মুখে দিয়ে যা।
এমন যার মা, তার ছেলে কি রকম হবে বোঝাই যায়।
সংগ্রাহক – সাংবাদিক রনজিত কুমার পাল (বাবু)
সংগৃহীতঃ Ramkrishna Mahapatra.