আন্তর্জাতিক

কাবুলের ভাগ্য নির্ভর করছে এরদোগানের ওপর

আফগানিস্তানে ন্যাটো মিশনে থাকা অন্য সব দেশের সৈন্যরা কাবুল ত্যাগ করলেও থেকে যাচ্ছে তুর্কিরা। শিগগিরই হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে নিতে যাচ্ছে তারা। কাবুল বিমানবন্দরে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানরা কাবুলের দখল নিতে সক্ষম হলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ পরিস্থিতি এড়ানোর ক্ষেত্রে কাবুলে তুর্কি উপস্থিতি সবচেয়ে বড় প্রভাবক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, আফগান গোত্রভিত্তিক সমাজকাঠামোর পুরোটায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মতো রাজনৈতিক সক্ষমতা তালেবানদের নেই। তালেবানরা কাবুলের দখল নিতে সক্ষম হলে গোটা আফগানিস্তানেই গৃহযুদ্ধ আরো মারাত্মক আকার নেবে। কাবুলে তুর্কি উপস্থিতি এ বিপর্যয় এড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপের দিকে গেলেও আফগানিস্তানে উভয় পক্ষের স্বার্থ অভিন্ন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়েই তুরস্ক এখন কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব হাতে তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সংস্থাগুলো মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে কাবুলের জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারের সমর্থনে প্রয়োজনে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের পথও সুগম হতে যাচ্ছে। এছাড়া আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবান ও তুরস্ক—দুই পক্ষেরই ঘনিষ্ঠ মিত্রতা রয়েছে। পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া তুরস্কের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে সক্ষম হবে না তালেবানরা। অন্যদিকে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না পাকিস্তানও। সেক্ষেত্রে তালেবানদের জন্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে দেখা দিতে পারে।

তালেবানরাও এখন বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তারা। কাবুলে উপস্থিতি তুরস্কের জন্য ভালো হবে না বলে তারা আঙ্কারাকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। তবে তালেবান হুমকি এ মুহূর্তে খুব একটা গায়ে মাখছে না আঙ্কারা। বরং কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে দেশটি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন রেজল্যুট সাপোর্ট মিশনের অংশ হিসেবে কাবুল বিমানবন্দরে ছয় বছর মেয়াদি সামরিক ও লজিস্টিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তুরস্ক। মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যরা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ মিশনের সমাপ্তি ঘটবে।

গত মাসের শুরুর দিকে ন্যাটো জোটভুক্ত নেতাদের এক সম্মেলন চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের পর এরদোগান ঘোষণা দেন, ন্যাটো মিশন শেষ হলেও তুর্কি সেনাদের কাবুল বিমানবন্দরে রেখে দেয়া হবে, যাতে তারা জোটের সৈন্য প্রত্যাহার কার্যক্রমে সহায়তার পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ভার তুলে নিতে পারে।

এর পর পরই তালেবানরা হুঁশিয়ারি দেয়, তুর্কি সৈন্যদের কাবুলে রেখে দেয়া হলে এর পরিণাম ভালো হবে না। এতে কর্ণপাত না করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তালেবানদের উচিত নিজ ভাইদের কাছ থেকে দখল করে নেয়া এলাকা ছেড়ে দেয়া। যাতে গোটা বিশ্বই দেখতে পায় আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে এসেছে।

বর্তমানে কাবুল বিমানবন্দরে তুরস্কের সামরিক মিশন নিয়ে আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আলোচনা চলছে। উভয় পক্ষই বলছে, এ আলোচনা বেশ ফলপ্রসূভাবেই এগোচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাটো জোটভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার সুসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে তুরস্কের।

তুর্কি সাংবাদিক ইলহান উজগেলের মতে, আঙ্কারা বর্তমানে কাবুল বিমানবন্দর মিশনকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করছে। মার্কিন সম্প্রচার সংস্থায় ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাবুলে উপস্থিতির মাধ্যমে এরদোগানের একেপি সরকার এখন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রয়াস চালাচ্ছে। এজন্য তারা ওয়াশিংটনের জন্য ভালো কিছু করে দেখাতে চায়। আঙ্কারা প্রমাণ করতে চাইছে, তুরস্ক মিত্র হিসেবে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ, যাকে চাইলেই উপেক্ষা করা যায় না।

এরদোগানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো বলছে, আলোচনার মাধ্যমে আফগান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এজন্য তালেবানদের প্রতি তিনি আলোচনার আহ্বানও জানিয়েছেন। এরদোগান বলেছেন, অনেক বিষয়ই রয়েছে, যেগুলো নিয়ে তালেবানদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। এর পরেও তারা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে, সেভাবে তুরস্কের সঙ্গেও আরো অনেক বেশি সহজভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্কের বর্তমান অবস্থানের সম্ভাব্য ফলাফল দুটি হতে পারে। প্রথমত, তালেবানদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে তুরস্ক। অথবা আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশটিতে প্লেমেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে আঙ্কারা। এরদোগানের বিশ্বাস, ন্যাটোর একমাত্র মুসলিমপ্রধান দেশের পরিচয় ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবেন তিনি।

পাকিস্তান ও কাতার বিশ্বব্যাপী তালেবানদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত। দেশ দুটির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে তুরস্কেরও। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এসব সম্পর্ককে কাজে লাগাতে পারেন এরদোগান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button