শিক্ষার মহান দিকপাল অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরীঃ শফিউল আজিম সুমনের স্মৃতিচারন
এনামুল হক রাশেদী, বাঁশখালী উপজেলা প্রতিনিধি-(চট্টগ্রাম)
শিক্ষার মহান দিকপাল অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরীঃ শফিউল আজিম সুমনের স্মৃতিচারন
উত্তর চট্টগ্রাম তথা বৃহত্তম চট্টগ্রামের শিক্ষার মহান এক দিকপাল অধ্যক্ষ মোহাঃ আলী আকবর চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী ২৯ এপ্রিল। শিক্ষার ফেরিওয়ালা খ্যাত জাতীর দক্ষ ও নিপুন এ কারিগরকে নিয়ে স্মৃতিচারন করেছেন তাঁরই যোগ্য ছাত্র, বিশিষ্ট্য ব্যাংকার ও আধ্যাত্মিক যুব নেতা মোহাঃ সৈয়দ শফিউল আজিম সুমনঃ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মো. আলী আকবর চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকী ২৯ এপ্রিল।
তিনি ১৯৫১ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার ডাবুয়া ইউনিয়নের কমলপতি গ্রামে মনু চৌধুরী বাড়ীর এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম মো. আব্দুস সালাম চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় ছিলেন এবং ভাইদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তিনি কমলপতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৬৩ সালে রাউজান আর.আর.এ.সি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.কম (অনার্স) এবং ১৯৭৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম.কম (অনার্স) পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এল,এল,বি পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষে তিনি অন্যান্য লোভনীয় পেশার পরিবর্তে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
তাও আবার পাশ্ববর্তী ফটিকছড়ি উপজেলায় আপামর জনগণের সার্বিক সহযোগীতায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী কলেজ- ফটিকছড়ি কলেজে ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। সে সময়ে শিক্ষকতা পেশা আজকের দিনের মত রৌদ্রজ্বল ছিল না বরং ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। মনে হয় স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম গ্রহণ করায় তিনি সে সময় শিক্ষকতার মত পেশাকে অবলম্বন করে টিকে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে ২৮ ফেব্র“য়ারী একই কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময় থেকে ২০০৮ সালের ২৬ আগষ্ট পর্যন্ত উক্ত পদে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
ওই বছরের ২৭ আগষ্ট উক্ত কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ৩ জুলাই অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত ফটিকছড়ি কলেজে উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্র-ছাত্রী দেশবিদেশে ছড়িয়ে আছে। ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও ফটিকছড়ি উপজেলার মাটি ও মানুষের সাথে মিশেছেন অকৃত্রিম ভাবে। তিনি ফটিকছড়ি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন কালে ফটিকছড়ি কলেজের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সার্বিক উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেছেন।
কলেজের চারপাশে সীমানা বেষ্ঠিত প্রাচীর নির্মাণ করা, কলেজ কম্পাউন্ডে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণ, কলেজ শপিং সেন্টারের নিচতলার কাজ সম্পন্ন, কলেজ শপিং সেন্টারের ২য় তলায় দুটি ব্যাংকের জন্য ভবন নির্মাণ কাজ, কলেজের পুরাতন ভবন মেরামত কাজ, ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেলের রান্নাঘর নির্মাণ, অধ্যক্ষ অফিস সংস্কার ও মেরামত, কলেজ ক্যাম্পাসে মসজিদের উদ্বোধন, কলেজের প্রবেশ গেইট নির্মাণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকাকালে প্রথম অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে কলেজ গর্ভনিং বডি গঠিত হয়েছিল।
যদিও তিনি তিন বছরেরও কম সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন, এই কম সময়ে ফটিকছড়ি ডিগ্রী কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকাকালেও নিয়মিত ক্লাস নিতেন। তাছাড়া তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রাম এর অধীনে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে হিসাব বিজ্ঞান ২য় পত্রের প্রধান পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করে অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছেন।
অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী ১৯৮২ সালে রাউজানের স্বনামধন্য দানবীর, শিক্ষানুরাগী, পদ্মা অয়েল কোম্পানীর প্রাক্তন অফিসার ও মেসার্স সুলতানপুর টেড্রার্স এর সত্বাধিকারী জনাব আলহাজ্ব মুহাম্মদ মুছা, (বি.কম) এর কন্যা মোসাম্মাৎ সাখেরা বেগম (বি.এ) কে বিবাহ করে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তিনি ছেলে মেয়েকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। বড় ছেলে রবিউল হাসান চৌধুরী অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে বর্তমানে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ জয়দেবপুর শাখায় অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
কন্যা সাকিলা নাছরীন লিটা ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকত্তোর ডিগ্রী অর্জন করে দাম্পত্য জীবনে পদার্পণ করেন। তাঁর স্বামী মুহাম্মদ ফুয়াদ হাসান পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে মো.মেজবাউল হাসান চৌধুরী তানভীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ইংরেজিতে অনার্স ও মাষ্টার্স শেষ করে বর্তমানে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিঃ রাউজান শাখায় অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলের স্ত্রী মোছাম্মাৎ নাসরিন সীমা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিঃ নাজিরহাট শাখায় কর্মরত আছেন। পারিবারিক জীবনে অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী খুবই সুখী ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি পারিবারিক সকল দায়িত্ব সুসম্পন্ন করেছেন।
অধ্যক্ষ মোঃ আলী আকবর চৌধুরী জীবদ্দশায় শিক্ষামূলক, সমাজসেবা, ধর্মীয় সংগঠন, পেশাগত সংগঠন, গবেষণা ও লেখালেখি সহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা লালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক শিক্ষক নেতা ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।
একজন সংগঠক হিসেবে সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠনের পাশাপাশি পেশাগত সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি চাকুরীর যোগদান থেকে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) চট্টগ্রাম জেলা শাখা ও ফটিকছড়ি উপজেলা শাখার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হিসাবে সমাজসেবা ও ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব এবং ফটিকছড়ি উপজেলা শাখার আহবায়ক ও সভাপতির পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
অধ্যক্ষ মোঃ আলী আকবর চৌধুরী দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরিফের সাজ্জাদানশীন আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়দ তাহের শাহ (ম.জি.আ.) এর একনিষ্ঠ মুরিদ ছিলেন এবং গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ চট্টগ্রাম জেলা উভয় শাখার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়া তিনি গাউছিয়া কমিটি ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ উভয় শাখার উপদেষ্ঠা মন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ত্বরীকতের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আওলিয়া প্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রায় সময় মাইজভান্ডার দরবার শরীফে জিয়ারতে যেতেন। ২০০২ সালে তিনি আজমীর শরীফ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাজার জিয়ারতে গিয়েছিলেন।
তিনি দীর্ঘদিন তাঁর নিজ গ্রামের আসকর চৌধুরী মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অধ্যাপনা থেকে অবসর নেয়ার পরে নিজ এলাকায় দুই শতক জায়গা দান পূর্বক যাবতীয় অর্থ ব্যয়ে “মনু চৌধুরী বাড়ি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এবং মত্যুর আগ পর্যন্ত উক্ত মসজিদের ইমামের সম্মানীসহ যাবতীয় ব্যয় নিজে বহণ করতেন যা অধ্যাবধি উনার পরিবার বহণ করে যাচ্ছে। বর্তমানে উক্ত মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাত সহকারে হয়। তাছাড়া তিনি ফটিকছড়ি জামেউল উলুম কামিল মাদ্রাসার মসজিদ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উক্ত মাদ্রাসার বিভিন্ন মাহফিলে সার্বিক সহযোগীতা করতেন।
কর্মক্ষেত্রের কারণে দীর্ঘকাল ফটিকছড়িতে পরিবার নিয়ে থাকা স্বত্ত্বেও শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। রাউজান উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের সাথে জড়িত থেকে উক্ত সংগঠনের কার্য-নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি রাউজান কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠনের আজীবন সদস্য ছিলেন এবং ২০১৩ সালে কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন “হিসাব বিজ্ঞান সমিতি”র উপদেষ্ঠামন্ডলীর সদস্য, আজীবন সদস্য হিসেবে জড়িত ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মাষ্টার্স ডিগ্রীধারীদের সংগঠন “সি.ইউ-৭৪ এর আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নিজ গ্রাম কমলপতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসময়ে উক্ত বিদ্যালয়ের পুরাতন দালান ভেঙ্গে নতুন দালান নির্মিত হয়েছিল এবং বিদ্যালয়ের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। তাছাড়া তিনি রাউজান সুরেশ বিদ্যায়তন উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল পরিচালনা কমিটির ও নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৩ সাল হতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফটিকছড়ি আদর্শ বৃত্তি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখালেখি করতেন। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে ফটিকছড়ি ডিগ্রী কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিনে তাঁর “হিসাব বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বাংলাদেশ” প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে রাউজান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন স্মরণিকায় অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরীর লিখিত “স্মৃতির পাতায়” প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাছাড়া তিনি ২০১৬ সালে রাউজানের ইতিহাস সম্বলিত “রাউজান একটি ঐতিহাসিক জনপদ” শিরোনামে ডায়েরীতে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু তিনি উক্ত লেখাটি প্রকাশের জন্য কোথাও দিয়েছেন কিনা তা আমার জানা নেই।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে জনাব অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরীকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ- ১. ফটিকছড়ি ডিগ্রী কলেজ থেকে অবসরজনিত বিদায় সংবর্ধনা ২. বাকশিষ চট্টগ্রাম জেলা থেকে বিদায় সংবর্ধনা ৩. রাউজান কলেজ সূবর্ণজয়ন্তীতে গুণীজন সংবর্ধনা ৪. মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে স্মারক সংবর্ধনা ৫. রাউজান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সংবর্ধনা।
অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ফটিকছড়ি ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনার সুবাধে ফটিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন বয়সের মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়েছিল। ওনার স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, কোন ছাত্র-ছাত্রী কততম ব্যাচের ছিলেন তা দীর্ঘদিন পরেও বলে দিতে পারতেন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
স্যারের সাথে আমার সর্ম্পকের সূত্রটা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। আমি ২০০০ সালে ফটিকছড়ি কলেজে ১ম বর্ষে অধ্যয়নকালে ব্যক্তিগত ভাবে স্যারের সাথে আমার পরিচয় হয়। কলেজের খুব কাছাকাছি আমার বাড়ি থাকা স্বত্তেও আমি ছিলাম অনিয়মিত ছাত্র। হিসাব বিজ্ঞানের প্রতি আমার প্রচুর আগ্রহ থাকায় নিয়মিত ক্লাস না করলেও আমি বাসায় উক্ত বিষয়ে নিয়মিত চর্চা করতাম। ১ম বর্ষের বার্ষিক পরীক্ষায় হিসাব বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ায় ক্লাসে এসে স্যার রোল নং-২২ কোথায় বলে আমার খোজ করেছিল এবং ক্লাসে বলে দিল আমি যাতে পরবর্তী ক্লাসে উপস্থিত থাকি। পরের ক্লাসে ভয়ে ভয়ে ধরপড় বুক নিয়ে স্যারের ক্লাসে উপস্থিত হলাম।
স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ক্লাসে থাকনা কেন? আমি নিশ্চুপ রইলাম। স্যার তখন বলল- হিসাব বিজ্ঞান কি বুঝে গেছ? আমি বললাম না স্যার। তাহলে এখন থেকে নিয়মিত আমার ক্লাসে থাকবে। আমি আচ্ছা বলে বসে গেলাম। এর পরের হিসাব বিজ্ঞান ক্লাসে সবার উদ্দেশ্যে স্যার একটি প্রশ্ন করলেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে যে এটির উত্তর করতে পারবে তাকে আমি পুরস্কৃত করব। স্যার তখন ২য় বর্ষের শুরুতে কোম্পানীর শেয়ার ইস্যু অধ্যায় থেকে আনুপাতিক হারে শেয়ার ইস্যুর জাবেদা নিয়ে একটি প্রশ্ন করলেন। কেউ উত্তর করতে পারল না, সবাই চুপচাপ রইল। আমার উত্তর জানা থাকা স্বত্ত্বেও চুপ রইলাম। কারণ সবাই চুপ, অন্যদিকে স্যার ক্লাসে খুবই গম্ভীর থাকতেন ও পাঠ নিয়ে সিরিয়াস থাকতেন। স্যার বলল, রোল- টুয়েন্টি টু কই? আমি দাড়ালাম।
তুমি পারবা না? আমি এবার জাবেদা টা বললাম। স্যার বলল, ঠবৎু এড়ড়ফ. উত্তর সঠিক হয়েছে। তিনি বললেন, তুমি কার কাছে প্রাইভেট পড়? আমি বললাম, স্যার আমি নিয়মিত ঘরে চর্চা করি। স্যার তখন বলল, চৎধপঃরপব সধশবং ধ সধহ ঢ়বৎভবপঃ. স্যার বলল, আগামী ক্লাসে তোমার পুরস্কার পাবে। স্যারের পরের ক্লাসে আমাকে একটি সুন্দর পার্কার কলম দিলেন। সে দিন থেকে স্যারের সাথে আমার অন্যরকম ভাললাগার সর্ম্পক সৃষ্টি হল। আমি যদি কোন ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারতাম স্যার আমার খোঁজ করতেন।
দায়িত্বের প্রতি স্যার বিন্দুমাত্র অবহেলা করতেন না, কর্তব্যনিষ্ঠায় ছিলেন তিনি পরিপূর্ণ। ২০০২ সালে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ফটিকছড়ি ডিগ্রী কলেজে ফলাফল বিপর্যয় হওয়ায় কমার্স গ্রুপ থেকে শুধু ০২ জন নিয়মিত ছাত্র পাশ করেছিলাম -গোলাম মোস্তফা ও আমি। তাই উক্ত কলেজে বি.কম কোর্সটি চালু রাখার নিমিত্তে আমাদের ভর্তির জন্য অধ্যক্ষ মহোদয় সহ স্যারদের অনুরোধ ছিল খুব বেশী। গোলাম মোস্তফা, আমি ও অনিয়মিত ব্যাচ থেকে পাশ করা মুহাম্মদ নাজমুল হক সহ আমরা তিনজন বি.কম কোর্সে ভর্তি হই। আমরা তিনজনকে নিয়েই স্যারেরা আমাদের নিয়মিত ক্লাস নিতেন।
আমার সহপাঠী অন্য দুইজন কলেজে অনুপস্থিত থাকা স্বত্বেও অধ্যক্ষ মোঃ আলী আকবর চৌধুরী আমি একজনকে নিয়ে শ্রেণীকক্ষে গিয়ে বহুবার ক্লাস নিয়েছেন। স্যারের মধ্যে কখনো কোন অবহেলা দেখিনি। বি.কম কোর্স সম্পন্ন করার পরও স্যারের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হত। কেননা স্যার ফটিকছড়ি ডাক বাংলোর পাশে লাকী ম্যানসনের পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাইজভান্ডার দরবার শরীফ গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বিশ্বঅলি শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর দয়াধণ্য ব্যক্তি ও মওলা হুজুর রাহবারে আলম, রহমতে আলম হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ.) এর চরণে আশ্রিত গোলাম, বিশিষ্ট মাইজভান্ডারী গবেষক জনাব মুহাম্মদ শাহেদ আলী চৌধুরী মাইজভান্ডারীলাকী ম্যানসনে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
মাইজভান্ডারী ত্বরীকার খুটিনাটি বিষয়াদি ও ধর্ম দর্শন নিয়ে জানার জন্য ওনার কাছে প্রায় প্রতিদিন আমার যাওয়া আসা হত। অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী পাশ্ববর্তী দালানে থাকার সুবাধে স্যারের সাথে আমার নিয়মিত দেখাশুনা কুশল বিনিময় হতো। বিভিন্ন সময়ে স্যার আমাকে বাসায় ডেকে নিতেন, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন, সময় কাটাতেন। স্যারের স্মরণশক্তি ছিল খুব প্রখর। ওনাকে একদিন আমি প্রশ্ন করলাম, স্যার কে কোন ব্যাচের তা আপনি কিভাবে বলতে পারেন বা স্মরণে রাখেন। স্যার বলেছিলেন, আমি আমার কর্মজীবনের প্রতি ব্যাচ থেকে একজনকে আইকন হিসাবে স্মরণে রাখি। তার কথা স্মরণ হলে ঐ ব্যাচের সকলের কথা মনে পড়ে। সত্যিই অসাধারণ কৌশল। স্যারের মধ্যে আমানতদারী ও সময়ানুবর্তিতা দেখেছি অপূর্বভাবে।
স্যার কারো সাথে দেখা করার বা মিটিং করার সময় দিলে, তিনি তা ডায়েরীতে নোট করে রাখতেন। তিনি কমপক্ষে পাঁচ মিনিট আগে হাজির হতেন; স্যারের জন্য কাউকে অপেক্ষা করতে হতো না। আমি দেখেছি, বিদেশ থেকে স্যারের ঠিকানায় অনেকে তাদের পরিবারে পাঠানো অর্থ বা ব্যাংক ড্রাফট পাঠাতেন। স্যার নিজে গিয়ে তাদের পরিবারে উক্ত অর্থ বা দ্রব্য পৌছিয়ে দিতেন। প্রতিটা কাজ বা কথাকে স্যার খুবই গুরত্ব দিতেন। তিনি স্পষ্ঠবাদী মানুষ ছিলেন। কোন বিষয়ে দ্বিমত থাকলে সরাসরি স্পষ্ঠভাবে বলে দিতেন। কোন সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে না পারলে তিনি তা এড়িয়ে চলতেন। এক কথায় স্যার ছিলেন- অ সধহ ড়ভ ঢ়ৎরহপরঢ়ষব. স্যারের মধ্যে অভিভাবকত্ব ও আন্তরিকতা দেখেছি খুব কাছ থেকে, ২০১২ সালে তিনি আমাকে দাম্পত্য জীবনে পদাপর্ণের জন্য প্রস্তাব দেন ও মধ্যস্থতা করেন। সে সময়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। স্যার আমাকে বলল, আমার আরেকজন প্রিয় ছাত্র মোঃ রেজাউল করিমের ছোট বোন রয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে ভাল সমন্বয় হবে মনে হচ্ছে।
তিনি আমার বাবা মা ও আমার মুরব্বী জনাব মুহাম্মদ শাহেদ আলী চৌধুরী সাহেবের মতামত নিয়ে পাত্রীপক্ষের সাথে সরাসরি কথা বলে বিবাহের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন ও মধ্যস্থতা করেছিলেন। আগে উল্লেখ করেছি, তিনি যে কোন কাজকে সিরিয়াসলি নিতেন। স্যার প্রাক্তন প্রিয় ছাত্রদের সাথে নিজ থেকে ফোনে যোগাযোগ করতেন। সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাটাও ছিল স্যারের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের অংশ। পূর্বকোণ পত্রিকা পড়া ছিল স্যারের নিত্যদিনের অভ্যাস। শেষ বয়ষে নিজ চোখে পত্রিকা পড়তে না পারলেও ছোট ছেলে তানভীরকে নিয়মিত পত্রিকা পড়ে শুনাতে হতো।
চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিল বোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিশেষ করে ডায়াবেটিকস, চোখের দৃষ্ঠিশক্তি কমে যাওয়া, এক পায়ে ক্ষত প্রভৃতি। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা ২০১৩ সালের ১৬ ই এপ্রিল ক্ষত সম্বলিত পা টি কেটে ফেলে। ফলে শেষ বয়সে এসে উনি অনেকটা গৃহবন্দী ও নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত উনার স্ত্রী ও সন্তানেরা নিয়মিত সাধ্যমত দেখাশুনা করেছেন। দীর্ঘদিন ফটিকছড়ি থাকার পর চিকিৎসা সুবিধা ও পরিবার পরিজনদের সুবিধার্তে ২০১৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর স্যারের প্রিয় ফটিকছড়ি থেকে চট্টগ্রাম শহরের খুলশীতে বাসা পরিবর্তন করেন। শহরে চলে গেলেও তিনি ফটিকছড়ির প্রিয়জনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মূখ্য সচিব জনাব আবদুল করিম, ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জনাব নুরুল আলম চৌধুরী, ফটিকছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আফতাব উদ্দীন চৌধুরী সহ অনেকে নিয়মিত স্যারের খোঁজ খবর নিতেন।
অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী ৬৯ বছর বয়সে ২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের খুলশীস্থ নিজ বাসভবনে আনুমানিক সকাল ৮টায় ইন্তেকাল করেন। রাউজান নিজ বাড়ীতে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মনু চৌধুরী বাড়ী মসজিদ সম্মুখ প্রাঙ্গনে তিনি শায়িত আছেন। পরিশেষে আমি অধম মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পাক দরবারে এই মানবতাবাদী, শিক্ষাবিদ আমার পরম শ্রদ্ধেয় প্রিয় শিক্ষক অধ্যক্ষ আলী আকবর চৌধুরী’র রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। ওনার সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, নম্রতা, সদালাপ, ধার্মিকতা, আমানতদারী, দূরদর্শীতা, বিচক্ষণতা, স্পষ্ঠবাদীতা ও সামাজিকতার মাধ্যমে ফটিকছড়ি বাসীর যে সেবা করেছেন তা ফটিকছড়িবাসী চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
লেখক- সৈয়দ শফিউল আজিম সুমন, সিনিয়র অফিসার, পূবালী ব্যাংক লিঃ, নাজিরহাট শাখা, সভাপতি, জ্যোতি ফোরাম।