সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মতত্ব- নারদ মুনির জন্ম ও কর্ম-বৃত্তান্ত
রনজিত কুমার পাল( বাবু), স্টাফ রিপোর্টারঃ
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মতত্ব- নারদ মুনির জন্ম ও কর্ম-বৃত্তান্ত
শ্রীব্যাসদেব তাঁর গুরু দেবর্ষি নারদের জন্ম ও কর্ম-বৃত্তান্ত শুনতে চাইলে নারদ মুনি বললেন, “হে মুনিবর, পূর্বকল্পে আমি বেদজ্ঞ ঋষিদের পরিচর্যারত এক দাসীর পুত্র ছিলাম। বর্ষা এবং শরৎকালের চারটি মাসে তাঁরা যখন একত্রে বসবাস করতেন তখন আমি তাঁদের সেবায় নিয়োজিত থাকতাম।
ঐসময় আমি একজন সংযত বালক ছিলাম এবং সব রকম শিশুসুলভ খেলাধুলার প্রতি ছিলাম উদাসীন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কথা বলতাম না। একবার অনুমতি গ্রহন পূর্বক আমি তাঁদের উচ্ছিষ্ট গ্রহন করায় আমার সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ বিদূরিত হয়। ফলে আমার হৃদয় নির্মল হয় এবং সেই সময সেই পরমার্থবাদীদের আচরনের প্রতি আমি আকৃষ্ট হই।”
‘হে ব্যাসদেব, সেই বেদজ্ঞ মুনিরা তাঁদের অহৈতুকি করুণার প্রভাবে আমাকে আশীর্বাদ করতেন। সেখানে সেই ঋষিরা প্রতিদিন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিত্তাকর্ষক কার্যকলাপের বর্ননা করতেন। তাঁদের অনুগ্রহে আমি তা নিবিষ্ট চিত্তে শ্রবণ করতাম। ফলে প্রতি পদে পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা শ্রবণে আমার রুচি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এভাবে ভগবানের মহিমা শ্রবণে আমি স্হিরমতি সম্পন্ন হই। সেই রুচি যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই আমি বুঝতে পারি যে আমার অজ্ঞানতার ফলে আমাকে এই স্হূল ও সূক্ষ্ম শরীর গ্রহন করতে হয়েছে, কেননা ভগবান এবং জীব উভয়ই প্রপঞ্চাতীত। এইভাবে এই দুটি ঋতুতে সেই মহান ঋষিদের দ্বারা কীর্তিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির কীর্তন শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভগবদ্ভক্তির প্রতি আমার প্রবৃত্তি যখন প্রবাহিত হতে শুরু করল, তখন রজ ও তমোগুণের আবরন বিদূরিত হয়ে গেলো। সেই ঋষিদের প্রতি আমি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁদের সেবা করার ফলে আমার সমস্ত পাপ মোচন হয়েছিল।
সেই ভক্তিবেদান্তরা চলে যাওয়ার সময় স্বয়ং ভগবান প্রদত্ত পরম গুহ্যজ্ঞান আমাকে দান করেছিলেন। সেই গুহ্যতম জ্ঞানের প্রভাবে আমি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং ধ্বংসকর্তা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তির প্রভাব স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম যা জানার ফলে সহজেই তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া যায় এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করা যায়।”
শ্রীনারদ মুনি বললেন, “সেই মহর্ষিরা, যাঁরা আমাকে পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন তাঁরা দূরদেশে চলে যাওয়ার পরও আমি এভাবেই আমার জীবন অতিবাহিত করছিলাম।”
” আমার মাতা একজন সাধারন স্ত্রীলোক এবং দাসী ছিলেন বলে তাঁর আর অন্য কোন আশ্রয় ছিল না। তাই তিনি আমাকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছা করলেও আমার জন্য কিছুই করতে পারতেন না। তথাপি আমি আমার মায়ের স্নেহের উপর নির্ভরশীল ছিলাম।”
” একসময় আমার মায়ের মৃত্যু হলে আমি সেটাকে ভক্তবৎসল ভগবানের বিশেষ কৃপা বলে মনে করে উত্তর দিকে যাত্রা করি। ”
” গৃহত্যাগ করার পর বহু জনপদ, নগর, গ্রাম, পাহাড়, পর্বত, বন জঙ্গল অতিক্রম করে দৈহিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে যাই। তখন নিকটস্ত নদীতে স্নান করে এবং জলপান করে শ্রান্তি দূর করি। তারপর জনমানবশুন্য এক অরন্যে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে উপবেশন করে অন্তরের অন্তঃস্হলে বিরাজমান পরমাত্মার ধ্যান শুরু করি। তখন আমার চিত্তে এক অপ্রাকৃত ভাবের উদয় হয়, আমার চক্ষুদ্বয় অশ্রুপ্লাবিত হয় এবং আমি অনুভব করি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি আমার হৃদয়কমলে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
কিন্তু সেই সময় প্রবল আনন্দের অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে পড়ায় ভগবানের রূপ দর্শন করতে না পেরে হঠাৎ বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়াই এবং ভগবানের সেই অপ্রাকৃত রূপ দর্শন করতে চাই। এইভাবে অতৃপ্ত হয়ে আমি শোকাতুর হয়ে পড়ি। সেই নির্জন স্থানে আমার প্রচেষ্টা দেখে ভগবান শ্রুতিমধুর স্বরে বললেন, “হে নারদ, এই জীবনে তুমি আর আমাকে দর্শন করতে পারবে না।
যাদের সেবা পূর্ণ হয়নি এবং যারা সব রকম জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারে নি, তারা আমাকে কদাচিৎ দর্শন করতে পারে। তুমি কেবল একবার মাত্র আমার রূপ দর্শন করেছ এবং তা কেবল আমার প্রতি তোমার আসক্তি বৃদ্ধি করার জন্য, কেননা তুমি যতই আমাকে লাভ করার জন্য লালায়িত হবে, ততই তুমি সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হবে।
অল্পকালের জন্যও যদি ভগবদ্ভক্ত সাধু-সেবা করা হয়, তাহলে আমার প্রতি সুদৃঢ় মতি উৎপন্ন হয়। তার ফলে সে দুঃখদায়ক এই জড় জগৎ ত্যাগ করার পর আমার অপ্রাকৃত ধামে আমার পার্ষদত্ব লাভ করে। আমার সেবায় নিবদ্ধ বুদ্ধি কখনও প্রতিহত হতে পারে না। সৃষ্টির সময় এমনকি প্রলয়ের সময়েও আমার কৃপায় তোমার স্মৃতি অপ্রতিহত থাকবে।”
তারপর থেকে নারদ মুনি ভগবানের দিব্য নাম এবং মহিমা নিরন্তর কীর্তন করতে শুরু করেন। এইভাবে ভগবানের মহিমা কীর্তন করতে করতে তিনি অত্যন্ত বিনীত এবং নির্মৎসর চিত্তে সমস্ত পৃথিবী পর্যটন করতে লাগলেন। তখন তাঁর আর কোন আসক্তি ছিল না।
সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, ঠিক যেভাবে তড়িৎ এবং আলোক যুগপৎভাবে দেখা যায়। পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গ করার উপযুক্ত একটি চিন্ময় শরীর লাভ করে তাঁর পঞ্চভৌতিক দেহটি ত্যাগ করেন এবং তার ফলে তাঁর সমস্ত কর্মফল নিবৃত্ত হয়।
কল্পান্তে যখন পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ কারণ বারিতে শয়ন করলেন, ব্রহ্মা তখন সৃষ্টির সমস্ত উপাদানগুলি নিয়ে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেন এবং তিনিও তখন ব্রহ্মার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেন।
৪৩০,০০,০০,০০০ সৌর বৎসর পর ব্রহ্মা যখন ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য মরীচি, অঙ্গিরা, অত্রি আদি ঋষিদের তাঁর দিব্য দেহ থেকে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁদের সাথে নারদ মুনিও আবির্ভূত হন। তখন থেকেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত বীনা বাজিয়ে স্বরব্রহ্ম বিভূষিত ভগবানের মহিমা নিরন্তর কীর্তন করতে করতে অপ্রাকৃত জগতে এবং জড় জগতের ত্রিভুবনে অপ্রতিহতভাবে বিচরন করতে থাকেন। যখনই তিনি ভগবানের মহিমা কীর্তন করেন তখনই তিনি অনুভব করেন যেন ভগবান তাঁর ডাক শুনে তাঁর হৃদয় আসনে আবির্ভূত হন।
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলেন, “যারা সর্বদাই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ভোগ বাসনায় আতুর, তারা এক অতি উপযুক্ত নৌকায় ভবসিন্ধু পার হতে পারে — তা হচ্ছে নিরন্তর পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত মহিমা কীর্তন করা। যোগ প্রণালীর দ্বারা ইন্দ্রিয় সংযমের অনুশীলনের মাধ্যমে কাম ও লোভের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু আত্মার আভ্যন্তরীণ পরিতৃপ্তির জন্য তা যথেষ্ট নয়, এই পরিতৃপ্তি কেবল পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবার মাধ্যমে লাভ করা যায়।” জয় নারদ মুনির জয়। আমাদের আদি গুরু নারদ মুনি। হরে কৃষ্ণ।