সুনামগঞ্জমরমী কবি হাছন রাজার ১৬৬তম জন্মদিন।
আব্দুছ ছালাম শাকিল, জেলা প্রতিনিধি-(সুনামগঞ্জ)
সুনামগঞ্জমরমী কবি হাছন রাজার ১৬৬তম জন্মদিন।
আজ ২১ ডিসেম্বর মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজার ১৬৬তম জন্মদিন।
মরমী কবি হাসন রাজার জন্মদিন পালন উপলক্ষে প্রতি বছরই সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়ে থাকলেও করোনা মহামারির কারণে এবারের জন্মদিনে কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়নি। তবে সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ভার্চুয়াল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি।
এছাড়া কবির পরিবারের পক্ষ থেকে সীমিত আকারে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তার তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম। হাছনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তার অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তারই নামের আকারে তার নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।
হাছন রাজার পূর্বপুরুষদের বংশানুক্রম হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।
বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্ এর প্রধান পথিকৃৎ। এর পাশাপাশি নাম করতে হয় ইবরাহীম তশ্না দুদ্দু শাহ্, পাঞ্জ শাহ্, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ্, শিতালং শাহ, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।
হাছন রাজার পোট্রের্ট
সিলেটে তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তার নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন।
পাঁচ লাখ বিঘার বিশাল অঞ্চলের জমিদার ছিলেন মরমী গীতিকবি হাসন রাজা। বেহিসাবী সম্পদ আর ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু এক সময় তার ভেতরের ভ্রান্তি ঘুচে যায়। তিনি কয়েকজন সঙ্গিনীকে নিয়ে হাওরে বজরায় ভাসতে থাকেন। সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় আবিষ্কার করেন ‘তার নিজের মধ্যেই তার বাস’।
বৈরাগ্যভাবের সূচনা:
হাছন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাছন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাছন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তার চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এ ভাবেঃ
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”
এভাবে প্রকাশ পেতে লাগলো তার বৈরাগ্যভাব। হাছন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে ‘চন্ড হাছন’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন ‘নম্র হাসন’। তার এক গানে আক্ষেপের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছেঃ
“ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন ”
পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তার উদ্যোগে হাসন এম.ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।
সঙ্গীত সাধনা:
হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ‘হাছন উদাস’ গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাছন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয়-‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার (লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,’মরমী কবি হাসন রাজা’)। ‘হাছন বাহার’ নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত। ঈশ্বানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তার গানে